চর্চাগীতির আবিষ্কারের ইতিহাস লিপিবদ্ধ করে এই সংকলনের নেপালে প্রাপ্তির সম্ভাব্য কারণ সমূহ নির্দেশ করাে।

উত্তর - চর্যাপদগুলিআবিষ্কারের কৃতিত্ব মহামহােপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর। তিনি ভারতীয় সংস্কৃতির ঐতিহ্যের নিদর্শন সংগ্রহ করার জন্য ভারত সরকার কর্তৃক দায়িত্ব পান। এই কর্মে নিযুক্ত হয়ে তিনি তাঁর পূর্বসূরী ভারততত্ত্ববিদ রাজেন্দ্রলাল মিত্র-র অনুসরণে ১৮৯৭-৯৮ খ্রীষ্টাব্দে পর পর দুবার নেপালে গিয়ে নেপালের রাজদরবার থেকে কিছু সংস্কৃত পুঁথি সংগ্রহ করে আনেন। ১৯০৭-এ তৃতীয়বার নেপালে গিয়ে কিছু অমূল্য উপাদান সংগ্রহকরেআনেন। মহামহােপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর সেইরত্ন সংগ্রহের মধ্যে বাংলাভাষায় লেখা (১) ‘চর্যাচর্যবিনিশ্চয়' শীর্ষক একটি পদ সংগ্রহ (2) সরহপাদের ‘দোহাবলী', (৩) অদ্বয়বজের সংস্কৃতে লেখা ‘সহজান্মায় পঞ্জিকা' নামক টীকা, (৪) কাহ্নপাদের (কৃষ্ণাচার্যের) দোহা, (৫) সংস্কৃতে লেখা জনৈক আচার্য পাদের ‘মেখলা' নামক টীকা ইত্যাদি পুঁথিগুলি ছিল। এগুলির সঙ্গে আগেরবারের সংগ্রহ করে নিয়ে আসা ‘ডাকার্ণব’ পুঁথিটিকে যুক্ত করে (সংস্কৃত টীকা পুঁথিদুটিকে বাদ দিয়ে) সমগ্র সংকলনটির নাম দেন “হাজার বছরের পুরাণ বালা ভাষার বৌদ্ধগান ও দোহা”। এই গ্রন্থ ১৯১৬ খ্রীষ্টাব্দে (১৩২৩ বঙ্গাব্দের শ্রাবণ) বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ থেকে প্রকাশিত হয়। ঐ চারখানি পুঁথি মুদ্রিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ভাষাতাত্ত্বিক, ঐতিহাসিক, সমাজতত্ত্ববিদ, সাহিত্যিক প্রমুখ বুধমণ্ডলে চাঞ্চল্য পরিলক্ষিত হয়। এই পুঁথির নাম নিয়ে বিতর্ক আছে। মহামহােপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর দেওয়া ‘চৰ্য্যাচর্যবিনিশ্চয়' নামটি বাতিল করে দিয়ে কেউ কেউ এর নাম ‘আশ্চৰ্য্যচর্যাচয়', কেউ বা ‘চৰ্য্যাশ্চর্যবিনিশ্চয়' নাম রাখার পক্ষপাতী ছিলেন। তবে হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর ‘চৰ্য্যাচর্যবিনিশ্চয়'নামটিবহুলপ্রচারিত হলেও এটি তার স্বকপােলকল্পিত বলে মনে হয়না। সম্ভবত নেপালের পুঁথিতে কোথাও তিনি এই নামটি পেয়েছিলেন। মূল গানের কোথাও কোথাও গানগুলি চর্যা’ নামে অভিহিত হয়েছে এবং টীকায় গানগুলি একাধিকবার চর্যা' নামে অভিহিত হয়েছে। আর বিনিশ্চয়'কথাটি তান্ত্রিক বৌদ্ধ ঐতিহ্যে একেবারে অপরিচিতনয়, অনঙ্গবজের প্রজ্ঞােপায়াধনিশ্চয় সিদ্ধি’বইটিতেশব্দটি গ্রন্থনামের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে এবং বৌদ্ধ আচার্য জেরির একখানিদার্শনিক গ্রন্থের নাম'ধর্মাধর্মবিনিশ্চয়'। এছাড়াঅন্যদিক থেকেও এইনামটির অর্থসঙ্গতি আছে, “যেগ্রন্থ আচরণীয় এবং অনাচরণীয়তত্ত্বসমূহকেবিশেষরূপেনিশ্চয় করিয়া দেয় - তাহাই চৰ্য্যাচর্যবিনিশ্চয়।”

এই পুঁথিরভাষার ব্যাপারেও বিতর্কের শেষ নেই। পুঁথির আবিস্কারক হরপ্রসাদ শাস্ত্রীমশাই জানিয়েছেন, “পদ ও অনেকের ভাষায় একটু আধটু ব্যাকরণের প্রভেদ আছে, তথাপি সমস্তই বাঙ্গালা বলিয়া বােধ হয়।” অনেকেই এই মত মানতে চাননি। ১৯২৬ খ্রীষ্টাব্দে ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় তাঁর The Origin and Development of the Bengali Language (ODBL) নামক সুবৃহৎ গবেষণাগ্রন্থে প্রতিপন্ন করেনযে, ধ্বনিতত্ত্ব ও ছন্দের বিচারে ডাকার্ণব’ও দোহাকোষগুলির ভাষাপশ্চিমা শৌরসেনী অপভ্রংশ এবং চর্যার ভাষা প্রাচীন বালা। তবে এইবাঙলায় শৌরসেনীঅপভ্রংশের প্রভাব অত্যন্ত বেশি।

নেপালে প্রাপ্তির সম্ভাব্য কারণঃ
‘চর্যাপদ' এবং ‘দোহাকোষ'ইত্যাদিপুঁথিগুলি পাওয়া গিয়েছিল নেপালের রাজদরবারেরগ্রন্থশালায়। তার কারণ খ্রষ্টিয় ১২০০ অব্দের পরে যখন একে একে মগধও বাল্লার নদিয়াতুর্ক আক্রমণে পরাজিত এবং অধিকৃত হয় তখন বাঙলা, মিথিলাপ্রভৃতি দেশের পণ্ডিতেরা তাদের পুঁথিপত্র, দেবমূর্তি, পটইত্যাদি সঙ্গে নিয়ে দেশত্যাগ করেন। তাঁরাকেউ কেউ পূর্ববঙ্গেআশ্রয় নিয়েছিলেন। নদীনালা পরিবেষ্টিতপূর্ববঙ্গ অন্ততঃতারাে একশ বছর তুর্কআক্রমণ ঠেকিয়ে রাখতে পেরেছিল। পণ্ডিতদের অধিকাংশইশরণার্থীহয়েছিলেন হিমালয়ের পাদদেশ হিন্দুরাজ্য নেপালে। তখন নেপাল ছিল বৌদ্ধ-নেওয়াড়ীদের। হিন্দু গাের্খারাজপুতেরাঅধিকার করে রাজ্য স্থাপন করে মাত্র অষ্টাদশ শতাব্দীতে। নেপালে মুসলমান বিজেতারা প্রবেশ লাভে সমর্থ হয়নি। তাই নেপালে অনেক দুষ্প্রাপ্য প্রাচীন পুঁথি সুরক্ষিত হয়। বাংলাও মিথিলার শিল্পকলাও শাস্ত্রচর্চা এইভাবে রূপলাভ করেছিল। নেপাল থেকে তাতিব্বতেও চিনেযায়। নেপালেও তিব্বতেতুর্কবিজয়ের পূর্বেরমগধ, মিথিলা ও গৌড়ের বৌদ্ধ ও হিন্দু তান্ত্রিক ধর্মের চিহ্ন অনুসন্ধান করা যায়। সেই ধর্ম ও সংস্কৃতির চর্চা নেপালে বহুদিন নিরাপদে চলেছিল।

‘চর্যাপদ’(দোহাকোষ) নেপালে যথেষ্ট শ্রদ্ধার বস্তুছিল। মূল চর্যালিপরবর্তীকালেঅনুলিখিত হয়েছিল। সংস্কৃত ভাষায় টীকারচিত হয়েছিল। তিব্বতী ভাষায় অনূদিত হয়েছিল ঐগুলি।
Write Your HideComments
Cancel

Please Do Not Enter Any Span Link in The Comment Box