ঔরঙ্গজেবের দাক্ষিণাত্য নীতি লেখ
ঔরঙ্গজেবের দাক্ষিণাত্য নীতি
ঔরঙ্গজেবের রাজত্বকালের অতি গুরুত্বপূর্ণ ও সুদূরপ্রসারী একটি বিষয় হল
তাঁর দক্ষিণাত্য নীতি । মোট শাসনকালের প্রায় অর্ধেক সময় ( ১৬৮২-১৭০৭ খ্রিঃ ) তিনি
দাক্ষিণাত্যে অতিবাহিত করেছিলেন । সম্রাট আকবর দাক্ষিণাত্যের উপর মুঘল আধিপত্যের সূচনা
করেছিলেন । ঔরঙ্গজেব তাকে চূড়ান্ত রূপ দিয়ে সমগ্র দাক্ষিণাত্যকে মুঘলের অধীনে আনার
পরিকল্পনা করেন ।ঔরঙ্গজেবের দাক্ষিণাত্য নীতির দুটি মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল —
প্রথমত, সাম্রাজ্যের সম্প্রসারণ এবং অ-সুন্নি মুসলমান
ও হিন্দুদের রাজনৈতিক কর্তৃত্ব বিনাশ করা : বিজাপুর ও গোলকুণ্ডার শিয়া সম্প্রদায়ভুক্ত
শাসকদ্বয় এবং মহারাষ্ট্রের হিন্দু-মারাঠা সর্দার শিবাজীকে দমন করে নিজ লক্ষ্য পূরণ
করতে সচেষ্ট হন । গোঁড়া সুন্নি মতে , বিশ্বাসী ঔরঙ্গজেব মনে করতেন যে , শিয়া রাজ্য
বিজাপুর ও গোলকুণ্ডাকে ধ্বংস করা তার নৈতিক কর্তব্য । সংশোধনবাদী ঐ দুটি রাজ্যকে গ্রাস
করা তিনি ইসলামের প্রতি দায়বদ্ধতা বলে বিশ্বাস করতেন ।
দ্বিতীয়ত, বিজাপুর আক্রমণ : অতঃপর
ঔরঙ্গজেব দাক্ষিণাত্যে অগ্রসর নীতি অনুসরণ করার সিদ্ধান্ত নেন । ১৬৬৮ থেকে ১৬৭৬ খ্রিস্টাব্দের
মধ্যে দাক্ষিণাত্যে মুঘল বিরোধী জোট আরও সংহত হয় । গোলকুণ্ডার ব্রাহ্মণ-মন্ত্রী মদন্ন
ও অকন্ন-র নেতৃত্বে বিজাপুর , গোলকুণ্ডা ও মারাঠাজাতি মুঘল বিরোধী জোট গঠন করে । বাহাদুর
খাঁ ও দিলীর খাঁ পরপর সুবাদার নিযুক্ত হয়েও এই জোট ভাঙতে ব্যর্থ হন । এরপর ঔরঙ্গজেব
নিজ পুত্র আজমকে বিজাপুর আক্রমণের নির্দেশ দেন ( ১৬৮০ খ্রিঃ ) । ১৬৮৫ খ্রিঃ বিদ্রোহী
পুত্র মহম্মদ আকবরকে অনুসরণ করে স্বয়ং ঔরঙ্গজেবও দাক্ষিণাত্যে উপস্থিত হন । ইতিমধ্যে
আজম বিজাপুরের বিভিন্ন অঞ্চল বিধ্বস্ত করে বিজাপুর অবরোধ করেন । সম্রাটের বাহিনী যোগদান
করলে বিজাপুরের প্রতিরোধ ভেঙে পড়ে । বিজাপুরের সম্রাট আদিল শাহ আত্মসমর্পণ করেন ।
তাকে কারাগারে নিক্ষেপ করা হয় এবং বিজাপুরকে মুঘল সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করা হয়
( ১৬৮৬ খ্রিঃ ) ।
বিজাপুর ও গোলকুণ্ডা দখল : সম্রাট
শাহজাহানের আমলে দাক্ষিণাত্যের সুবাদার হিসেবে ঔরঙ্গজেব বিজাপুর ও গোলকুণ্ডা রাজ্য
দুটি দখল করার পরিকল্পনা করেছিলেন । কিন্তু শাহজাহান ও দারাশুকোহর বিরোধিতার জন্য তার
ইচ্ছা পূরণ করতে পারেননি । সম্রাট হবার পর ঔরঙ্গজেব দাক্ষিণাত্যে স্বীয় সিদ্ধান্ত
বাস্তবায়িত করতে উদ্যোগী হন । তবে ওই সময়ে দাক্ষিণাত্যে মারাঠাদের উত্থানের বিষয়ে
তিনি সচেতন ছিলেন । তাই সম্রাট হবার অব্যবহিত পরবর্তী কয়েক বছর তিনি দাক্ষিণাত্যে
আগ্রাসনের পরিবর্তে সমঝোতার নীতি অনুসরণ করেন । তা ছাড়া ওই সময়ে উত্তর ভারতে একাধিক
সমস্যায় তিনি বিব্রত ছিলেন । তাই পূর্ণ উদ্যমে দাক্ষিণাত্যের সমস্যা সমাধানে অগ্রসর
হতে পারেননি । কিন্তু কয়েক বছরে উত্তর ভারতের সমস্যা কিছুটা মিটলে তিনি দাক্ষিণাত্যের
প্রতি নজর দেন । একই সময়ে শিবাজীর নেতৃত্বে মারাঠা জাতির অভ্যুত্থান তাকে দাক্ষিণাত্যের
বিষয়ে কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণে বাধ্য করে ।
গোলকুণ্ডা আক্রমণ : বিজাপুরের
পর ঔরঙ্গজেব গোলকুণ্ডা দখল করতে উদ্যোগী হন । আসলে বিজাপুরের পতনের ফলে গোলকুণ্ডার
পতনও অনিবার্য হয়ে পড়ে । গোলকুণ্ডার শাসক মুঘলদের নিয়মিত কর প্রদান করলেও এই শিয়া-রাজ্যটিকে
গ্রাস করার ইচ্ছা ঔরঙ্গজেবের আগে থেকেই ছিল । আবার মদন্ন ও অকন্ন-র মতো বিধর্মী হিন্দুর
নেতৃত্বে গোলকুণ্ডা মুঘল বিরোধী জোট গঠন করলে ঔরঙ্গজেব এই রাজ্য গ্রাস করতে উদ্যোগী
হন । বিজাপুরের পতন তাঁর এই কাজকে সহজতর করে দেয় । ১৬৮৬ খ্রিস্টাব্দে গোলকুণ্ডার কুতুব
শাহি বংশের বিরুদ্ধে ঔরঙ্গজেব মুঘলবাহিনী প্রেরণ করেন । এক বছরের মধ্যেই গোলকুণ্ডার
পতন ঘটে । গোলকুণ্ডার সুলতান আবুল হাসান মুঘলবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেন । আবুল হাসান
বন্দি হন এবং গোলকুণ্ডা মুঘল সাম্রাজ্য ভুক্ত হয় ।
ঔরঙ্গজেব-মারাঠা সংঘাত : বিজাপুর
ও গোলকুণ্ডার পতন ঘটলেও দাক্ষিণাত্যে মুঘল কর্তৃত্বের পথে বড়ো বাধাস্বরূপ মারাঠারা
তখনও বিদ্যমান । প্রসঙ্গত স্মরণ করা যেতে পারে যে , শিবাজী জাতীয়তাবোধ ও ধর্মীয় প্রেরণায়
উদ্বুদ্ধ করে বিচ্ছিন্ন মারাঠা জাতিকে একটি ঐক্যবদ্ধ শক্তিতে পরিণত করতে সক্ষম হয়েছিলেন
। শিবাজীর হিন্দু রাষ্ট্রের আদর্শ ঔরঙ্গজেবের ক্রোধকে ভীষণভাবে বাড়িয়ে দিয়েছিল ।
তাই শিবাজীকে দমন করার জন্য তিনি একে একে শায়েস্তা খাঁ ( ১৬৬৩ খ্রিঃ ) , জয়সিংহ ও
দিলীর খাঁ কে ( ১৬৬৫ খ্রিঃ ) নিযুক্ত করেন । কিন্তু শিবাজীর কর্মদক্ষতা , সাহস ও কূটকৌশলের
কাছে এরা সবাই পরাজিত হন । ঔরঙ্গজেব মিথ্যা কথা বলে শিবাজীকে মুঘলদুর্গে বন্দি করে
রাখার যে পরিকল্পনা করেন , শিবাজীর তীক্ষ্ণবুদ্ধির ফলে তা-ও ব্যর্থ হয় । অতঃপর শিবাজী
সৈন্য সংগ্রহ করে মুঘলবাহিনীর সাথে সংঘর্ষের জন্য প্রস্তুত হন । ১৬৭০ খ্রিস্টাব্দে
পুনরায় শিবাজীর সাথে মুঘলের সংঘর্ষ শুরু হয় । শিবাজী পুরন্দরের সন্ধি দ্বারা ( ১৬৬৫
খ্রিঃ ) মুঘলদের যেসব স্থান ও দুর্গ ছেড়ে দিয়েছিলেন , সেগুলি দখল করতে শুরু করেন
। তিনি একে একে পুরন্দর , মাদুরা ও কোঙ্কন অধিকার করেন এবং কোঙ্কন থেকে মুঘল সুবাদারকে
বহিস্কৃত করেন । ১৬৭৪ খ্রিস্টাব্দে শিবাজী স্বাধীন রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করেন এবং নিজে
‘ ছত্রপতি ’ উপাধি নেন । শিবাজীর মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র শম্ভুজীর সাথে ঔরঙ্গজেবের যুদ্ধ
হয় । তবে তিনি ঔরঙ্গজেবের হাতে বন্দি ও নিহত হন । শম্ভুজীর মৃত্যুর পর তাঁর ভ্রাতা
রাজারামের নেতৃত্বে মারাঠা-মুঘল সংঘর্ষ চলতে থাকে । রাজারামের মৃত্যুর পর তাঁর স্ত্রী
তারাবাঈ মুঘল বিরোধী অভিযান চালিয়ে যেতে থাকেন । এমন অবস্থায় ঔরঙ্গজেবের মৃত্যু হয়
( ১৭০৭ খ্রিঃ ) ।