বক্সারের যুদ্ধের কারন ও ফলাফল আলোচনা করো।
বক্সারের যুদ্ধের কারন ও ফলাফল
➧ সূচনা/পটভূমি – ১৭৬০ সালে
ক্লাইভ বিলেত চলে যান। ক্লাইভের মতো পৃষ্ঠপোষক ও অভিভাবক হারিয়ে মীরজাফর অসহায় হয়ে
পড়েন। তা ছাড়া খড়কুটো ধরে বাঁচার লক্ষ্যে ওলন্দাজদের সাথে ষড়যন্ত্র করার পর তিনি
ইংরেজদের বিশ্বাস ও সমর্থন হারিয়েছিলেন। অধিকন্তু ইংরেজদের পুনঃপুন টাকার দাবি মেটাতে
পারছিলেন না। সে জন্য ইংরেজ কর্তৃপক্ষ হলওয়েল ও ভেনসিটার্ট মীরজাফরকে সরিয়ে তার জামাতা
মীর কাসিমকে মসনদে বসানোর পরিকল্পনা করে। তাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী ১৭৬০ সালের অক্টোবরে
মীর কাসিমকে মসনদে বসায়। নবাবীর বিনিময়ে মীর কাসিম ইংরেজ প্রধানদের বহু অর্থ উপঢৌকন
দেন। তা ছাড়া বর্ধমান, মেদেনীপুর ও চট্টগ্রাম জেলা কোম্পানিকে দান করে দিতে বাধ্য
হন। মীর কাসিম অনেকটা স্বাধীনচেতা ছিলেন। ইংরেজ
আশ্রিত অবস্থান থেকে নবাবের শাসনক্ষমতা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে চেষ্টা করেছিলেন। নবাব এ
সময় কয়েকজন হিন্দু কর্মচারী, জমিদার ও ব্যবসায়ীর অবাধ্যতায় বিরক্ত হয়ে ওঠেন। এ
জন্য আজিমাবাদের নায়েম নাযিম রামনারায়ণ, গুপ্ত পুলিশ বিভাগের কর্মকর্তা রাজা মুরলী
ধর এবং রাজবল্লভ, জগৎশেঠ ও অন্যদের গ্রেফতার করেন। ইংরেজদের সাথে ষড়যন্ত্র করার অপরাধে
রামনারায়ণ, রাজবল্লভ, উমেদরায়, জগৎশেঠ এবং আরো কয়েকজনের প্রাণদণ্ড হয়। ইংরেজদের
প্রভাব থেকে অব্যাহতি পাওয়ার জন্য মীর কাসিম তার রাজধানী মুর্শিদাবাদ থেকে মুঙ্গের
এ স্থানান্তর করেন। বিলম্বিত বোধোদয়ের কারণে তিনি ইংরেজদের বিনাশুল্কে বে-আইনি ব্যবসায়
নিষিদ্ধ করে আদেশ জারি করেন। কোম্পানির কর্মকর্তারা এর বিরোধিতা করায় তিনি সব বণিকের
পণ্যদ্রব্যের ওপর হতে শুল্ক রহিত করে দেন। এই ব্যবস্থার ফলে বাণিজ্যে ইংরেজদের একচেটিয়া
ও বিশেষ সুবিধা নষ্ট হয়। কারণ এর ফলে তাদের অন্য বণিকদের সাথে সমপর্যায়ে ব্যবসায়ে
প্রতিযোগিতা করতে হতো।
পলাশীর যুদ্ধের জয়লাভের ফলে ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলার ‘কিং মেকার’
– এ পরিণত হয় । মিরজাফরকে সিংহাসনে বসিয়ে তারা বাংলায় বিনাশুল্কে বানিজ্যের অবাধ অধিকার
ও চব্বিশ পরগনার জমিদার লাভ করে । কিন্তু ক্লাইভের উদ্দত আচরণ, নবাবের প্রতি অসন্মান,
ক্রমাগত অর্থ শোষণ প্রভৃতি কারনে মিরজাফর বিরক্ত হন । ইংরেজদের ক্ষমতা খর্ব করার জন্য
তিনি গোপনে ওলন্দাজদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন । খবর পেয়ে ক্লাইভ বিদারার যুদ্ধে ওলন্দাজদের
পরাজিত করেন । আর ওলন্দাজদের সঙ্গে ষড়যন্ত্রে যুক্ত থাকার অভিযোগে মিরজাফরকে পদচ্যুত
করে তার জামাতা মিরকাশিমকে বাংলার সিংহাসনে বসান । এভাবে বিনা রক্তপাতে নবাব পরিবর্তনের
ঘটনা ‘১৭৬০ সালের বিপ্লব’ নামে পরিচিত ।
এ সব কারণে মীর কাসিমের সাথে ইংরেজদের স্বার্থের সংঘাত দেখা দেয়। ১৭৬৩ সালে ইংরেজদের সাথে তার সংঘর্ষ বেধে যায়। কাটোয়া, মুর্শিদাবাদ, গিরিয়া, সুতি, উদয়নালা ও মুঙ্গেরের যুদ্ধে পরাজিত হয়ে মীর কাসিম ক্ষমতাহারা অবস্থায় অযোধ্যায় আশ্রয় গ্রহণ করেন। ১৭৬৩ সালে কোম্পানির কর্মকর্তারা দ্বিতীয়বার ক্লাইভের গর্দভ খ্যাত মীরজাফরকে বাংলার সিংহাসনে বসায়।
➧ বক্সারের যুদ্ধের কারণ -
[1] মিরকাশিমের স্বাধীনচেতা মনোভাব:
মিরকাশিম আলি খান পূর্ব ভারতে এক স্বাধীন রাজ্য গড়ে তোলার জন্য বদ্ধপরিকর ছিলেন। এই
লক্ষ্যপূরণের জন্য তিনি আর্থিক ও সামরিক বিভাগকে শক্তিশালী করার উদ্যোগ নেন। এ ছাড়াও
ইংরেজদের প্রভাব থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীনভাবে রাজ্য পরিচালনার লক্ষ্যে তিনি মুরশিদাবাদ
থেকে মুঙ্গেরে (বিহারে) রাজধানী স্থানান্তর করেন। তার এই উদ্যোগ ইংরেজদের সঙ্গে সংঘর্ষের
পরিস্থিতি তৈরি করে।
[2] আর্থিক পদক্ষেপ: একজন স্বাধীন
নবাবের মতোই মিরকাশিম আর্থিক সংস্কারের দ্বারা অর্থনীতিকে শক্তিশালী করতে চেয়েছিলেন।
তিনি—
[i] জমিদারদের ওপর কয়েকটি বাড়তি কর চাপান ও ভূমিরাজস্বের হার দেড় আনা
বাড়ান।
[ii] ইংরেজদের প্রতি অনুগত রয়েছেন—এমন কর্মচারী
ও জমিদারদেরও তিনি কঠোর হাতে দমন করেন। ইংরেজ মদতপুষ্ট বিহারের নায়েব দেওয়ান নবাবের
প্রাপ্য অর্থ পরিশোধ ও হিসাবপত্র দাখিলের আদেশ অগ্রাহ্য করলে তিনি রামনারায়ণকে হত্যা
করেন।
[iii] রাজস্ব আত্মসাৎকারী উচ্চপদস্থ কর্মচারীদের চিহ্নিত করে তাদের সম্পত্তি
বাজেয়াপ্ত করেন ও কঠোর শাস্তি দেন।
[iv] আলিবর্দি ও মিরজাফরের পরিবারবর্গের কাছ থেকে অসাধু উপায়ে অর্জিত ও
সঞ্চিত অর্থ জোর করে আদায় করেন।
[3] সামরিক উদ্যোগ: মিরকাশিম
এক প্রশিক্ষিত ও সুসজ্জিত সামরিক বাহিনী গঠনের উদ্যোগ নেন। ইউরোপীয় রণকৌশল গ্রহণের
পাশাপাশি তিনি উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের আফগান, তাতার পারসিক এবং আর্মেনীয়দের
সেনাদলে অন্তর্ভুক্ত করেন। আর্মেনীয় গ্রেগরি (গুরগিন খাঁ)-কে তিনি তার প্রধান সেনাপতি
ও ওলন্দাজ বাহিনীর প্রধান হিসেবে নিয়োগ করেন। ফরাসি সমরু (ওয়াল্টার রাইন হাউন্ড)-কে
ও আর্মেনীয় মার্কারকে তিনি অন্য সমর বিভাগের সেনাপতি নিযুক্ত করেন। এ ছাড়াও আর্মেনীয়
কারিগরদের সাহায্য নিয়ে তিনি মুঙ্গেরে কামান ও বন্দুক তৈরির এক অস্ত্রকারখানা নির্মাণ
করেন। মিরকাশিমের এই সামরিক উদ্যোগ যুদ্ধ পরিস্থিতি তৈরি করে।
[4] শুল্ক বিবাদ: কোম্পানির কর্মচারীরা যথেচ্ছভাবে ব্যক্তিগত বাণিজ্য দস্তক বা শুল্ক ছাড়ের সুবিধা নিতে শুরু করে। পরিণামে দেশীয় বণিকগোষ্ঠীর বাণিজ্য ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং নবাবও তাঁর প্রাপ্য রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হন। মিরকাশিম এই সংকটমোচনের জন্য ভ্যান্সিটার্ট-এর কাছে এক আবেদন জানান। কিন্তু তাতেও সংকটের নিরসন না হওয়ায় মিরকাশিম দেশীয় বণিকদের ওপর থেকে শুল্ক তুলে নেন। ফলে কোম্পানিকে দেশীয় বণিকদের সঙ্গে প্রতিযোগিতামূলক বাণিজ্যের মুখােমুখি হতে হয়। এতে ইংরেজদের ধৈর্যচ্যুতি ঘটে ও তারা মিরকাশিমকে উচিত শিক্ষা দেওয়ার জন্য তৈরি হয়। ফলে ইংরেজ ও কোম্পানি, উভয়ের মধ্যে সংঘর্ষ অনিবার্য হয়ে পড়ে। সংঘটিত হয় বক্সারের যুদ্ধ (১৭৬৪ খ্রি. ২২ অক্টোবর)। মিরকাশিমের সেনাপতি মার্কার ও ইংরেজ সেনাপতি মেজর হেক্টর মনরোর কাছে পরাজিত (১৭৬৪ খ্রি. ২২ অক্টোবর) হলে, ব্রিটিশ শক্তি সুদৃঢ় হয়।
➧ বক্সার যুদ্ধের ফলাফল ও গুরুত্ব -
[1] ভাগ্য নির্ণায়ক যুদ্ধ হিসেবে:
বক্সারের যুদ্ধ ছিল ভারতের ইতিহাসে এক ভাগ্য নির্ণায়ক যুদ্ধ। এই যুদ্ধের ফলাফল যদি
ইংরেজদের প্রতিকূলে যেত তাহলে ভারতের ইতিহাস অন্যরকমভাবে লেখা হত।
[2] ঔপনিবেশিক শাসনের দৃঢ়তায়:
পলাশির যুদ্ধে জিতে কোম্পানি ভারতে ঔপনিবেশিক প্রথম ধাপ অতিক্রম করেছিল। কিন্তু বক্সারের
যুদ্ধে জিতে কোম্পানি ভারতের ঔপনিবেশিক শাসনকে দঢ় ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত করে।
[3] বাংলায় আধিপত্য প্রতিষ্ঠায়:
বক্সারের যুদ্ধে বাংলার শেষ স্বাধীনচেতা নবাব মিরকাশিমের পরাজয় ঘটায় ব্রিটিশ শক্তিকে
বাধা দেওয়ার মতো আর কোনো শাসক রইল না, ফলে বাংলায় কোম্পানির আধিপত্য প্রতিষ্ঠার পথ
নিস্কণ্টক হল।
[4] উত্তর ভারতে আধিপত্য সূচনায়:
বক্সারের যুদ্ধে জিতে কোম্পানি বাংলার আধিপত্যকে দৃঢ় করে উত্তর ভারতের দিকে নজর দেয়।
অযোধ্যায় নবাব সুজা-উদদৌলা কোম্পানির অনুগত হন এবং নামসর্বস্ব মোগল বাদশা কোম্পানির
দয়ার ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েন। ফলে সমগ্র উত্তর ভারত জুড়ে কোম্পানির আধিপত্যের সূচনা
ঘটে।
[4] আর্থিক লুণ্ঠনের সূচনায়:
বক্সারের যুদ্ধে জয়লাভের পর বাংলার বাণিজ্য ও অর্থনীতির ওপর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির
একচেটিয়া আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। বাংলায় কোম্পানির অবাধ অর্থনৈতিক লুণ্ঠন শুরু হয়।
কোম্পানির উচ্চপদস্থ আমলারা নতুন নবাব নজম-উদদৌলার কাছ থেকে পনেরো লক্ষ টাকা উপঢৌকন
হিসেবে আদায় করে। এর পাশাপাশি যুদ্ধের ক্ষতিপূরণ বাবদ অযোধ্যার নবাব সুজা-উদদৌলার
কাছ থেকে পঞ্চাশ লক্ষ টাকা আদায় করা হয়।
[5] দেওয়ানি লাভের ক্ষেত্রে:
বক্সারের যুদ্ধে চরম প্রাপ্তি হিসেবে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলা, বিহার ও ওড়িশায়
দেওয়ানি লাভ করেছিল। দেওয়ানি লাভের ফলে একদিকে বাংলার রাজনীতিতে কোম্পানির কর্তৃত্ব
দৃঢ় হয়েছিল অপরদিকে কোম্পানির আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্য বহুগুণ বেড়েছিল। উপসংহার: বক্সারের যুদ্ধের পরেই বণিকের মানদণ্ড
শাসকের রাজদণ্ডরূপে দেখা দিয়েছিল। বক্সারের যুদ্ধে জেতার পর থেকেই ভারতের ইতিহাসে
প্রকৃতপক্ষে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের সূচনা হয়।