ভারতীয় নবজাগরণের প্রবর্তক রাজা রামমোহন রায়ের ভূমিকা আলোচনা কর ।
রামমােহন : উনবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে ভারতে যে নবজাগরণের সূচনা তার প্রধান ঋত্বিকছিলেন রামমােহন। রায়। এটা সত্যই যে কোনাে একজন ব্যক্তির একক প্রচেষ্টায়
রামমােহন : উনবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে ভারতে যে নবজাগরণের সূচনা তার প্রধান ঋত্বিকছিলেন রামমােহন। রায়। এটা সত্যই যে কোনাে একজন ব্যক্তির একক প্রচেষ্টায় কোনো মেধাভিত্তিক আন্দোলন শুরু হতে পারে । এই ধরনের আন্দোলন সবসময় একটি সহযােগীতামূলক ও সমন্বয়ী আন্দোলন হিসাবেই পরিচিত হয় সেখানে কতিপয় ব্যক্তির যুগ্ন প্রয়াসে এক ধরনের সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে সমাজ প্রগতির পথে এগিয়ে চলে। তবে একথাও সত্য যে এই সমস্ত সাংস্কৃতিক পুনর্জাগরণের আন্দোলনে অনেকসময়ই একজন্য ব্যক্তি বা কতিপয় গােষ্ঠীর বিশেষ বিশেষ অবদান থাকে। রামমােহন ছিলেন এমনই একজন ব্যক্তিত্ব যিনি ভারতের সামাজিক রাজনৈতিক ব্যবস্থার ব্যাধিগুলিকে চিহ্নিত করতে পেরেছিলেন এবং সেই অনড় ভারতীয় সমাজকে প্রগতির পথে চালিত করতে সমর্থ হয়েছিলেন। রামমােহনের নানামুখী গুণগত চরিত্র ও কার্যকারীতার কারণেই রবীন্দ্রনাথ তাকে ভারতপথিক আখ্যা দিয়েছিলেন তবে অনেকের মতেই সমগ্র মানবজাতির ঐক্যসাধনের নির্যাস তাঁর তত্ত্বে প্রতিফলিত হয় বলেই তাকে ‘বিশ্বপথিক’ রূপে চিহ্নিত করা হয়।
রামমােহন তাঁর চিন্তাভাবনায় প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যকে মিশিয়েছিলেন এই কারণেই যে তিনি পাশ্চাত্য জ্ঞানবিজ্ঞান, কৃৎকৌশল এবং দর্শনকে ভারতীয় বৈদান্তিক কাঠামােয় বিচার বিশ্লেষণ করে তার ভিত্তিতে ভারতীয় সমাজ সংস্কারের প্রস্তাব রেখেছিলেন। পাশ্চাত্য রাষ্ট্রদর্শনের মধ্যে বেন্থাম ও মন্তেন্ধুর চিন্তাভাবনাই তাকে প্রভাবিত করেছিল বেশি। ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরন এবং আইনের শাসন এই দুইয়ের ভিত্তিতে এবং একধরনের
আরােহী বা inductive পদ্ধতি অবলম্বন করে তিনি বলেছিলেন স্থান, কাল, অবস্থা প্রয়ােজন ও কার্যকারীতার দিক থেকে আইনকে প্রযুক্ত হতে হবে এবং এই পথেই তিনি ভারতীয় সমাজের অন্ধ জড়বৎ সামাজিক অবস্থানকে স্থানচ্যুত করে এক যুক্তিভিত্তিক সমাজ গঠনে আগ্রহী ছিলেন। প্রখর মেধা সম্পন্ন রামমােহন এইভাবে তাঁর ধর্মীয় সংস্কৃতিক ভাবনায়, প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যর মিলন ঘটিয়েছিলেন ও বিশ্ব নাগরিকত্বের সার্বভৌমিকতায় আস্থাবান হয়ে উঠেছিলেন।
ভারতীয় সমাজের পক্ষে ব্রিটিশ শাসনকে তিনি আর্শীবাদ স্বরূপ মনে করতেন। পাশ্চাত্য সভ্যতার বিশেষকরে পাশ্চাত্য শিক্ষার ও পাশ্চাত্য যুক্তিবাদী জীবনর্শনের তিনি ছিলেন একান্তই গুণগ্রাহী, তার চিন্তায় এই দুয়ের সম্মিলনেই ভারতীয় সমাজের অন্ধ, স্থানুবত সংস্কারগ্রস্ত জীবনচর্চার অবসান ঘটবে এবং ভারতীয় মননের উপযুক্ত বিকাশ ঘটবে, এবং এর মধ্যেই তিনি নবজাগরণের বীজকে সুপ্ত থাকতে জেনেছিলেন। নবজাগরণে মূলমন্ত্রকে যুক্তিবাদ, এবং সেই যুক্তিবাদের মূল উৎস যে পশ্চিমী শিক্ষা, তার প্রতি গুরুত্ব দিয়েই রামমােহন ভারতে যুক্তিবাদী শিক্ষা ও শিক্ষণ ব্যবস্থা চালু করতে চেয়েছিলেন। ইউরােপীয় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, আধুনিক দর্শন ও ইতিহাস পাশ্চাত্য বস্তুমুখী বিজ্ঞানচর্চা প্রভৃতির প্রণয়ন করে ভারতীয় যুব মানসে তিনি এক বিশাল পরিবর্তন আনতে চেয়েছিলেন; প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ করা যায়, হিন্দু কলেজের প্রতিষ্ঠা লগ্নে তার অবদান ও কিছু কম ছিল না। ভারতীয় যুব মানসে নতুন উদ্দীপনা আনয়নের প্রশ্নেই, রামমােহন পাশ্চাত্য শিক্ষার গুণগ্রাহী হয়ে উঠেছিলেন।
ভারতে এক আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা গড়ে তােলার ক্ষেত্রে রামমােহনের এই দৃষ্টিভঙ্গী খুবই সহায়ক ছিল। ভারতীয় সমাজকে বাস্তবমুখী করে তােলার জন্য পাশ্চাত্য যুক্তিবাদী শিক্ষার প্রবর্তন দরকার, এই ছিল তার মত। সনাতন ও মধ্যযুগীয় ভারতীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের সাথে পাশ্চাত্য সামাজিক মূল্যবােধের সমন্বয় ঘটিয়ে আধুনিক এক রাষ্ট্রব্যবস্থার ভিত্তি স্থাপন করতে চেয়েছিলেন রামমােহন। ভারতীয় রাষ্টিক জীবনে মধ্যবিত্তের উত্থানকে তিনি প্রতিভাত করেছিলেন এবং এই উদারচেতা পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত যুক্তিবাদী মধ্যবিত্তের হাত ধরেই ভারতে আধুনিক রাষ্ট্র ও রাজনৈতিক জীবনের আবির্ভাব ঘটবে, এই ছিল তার প্রত্যয়।
উনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে উদ্ভূত এই ভারতীয় নবজাগরণকে কতটা সত্যিকারের “নবজাগরণ” বলা যায়, এই নিয়ে ঐতিহাসিক ও সমাজবিজ্ঞানীদের মধ্যে বিতর্ক রয়েছে। অনেকেই নবজাগরণ অপেক্ষা সাংস্কৃতিক উদ্ভাবন এই শব্দবন্ধটি ব্যবহার করার পক্ষপাতী। একথা ঠিক ইউরােপীয় নবজাগরণের চরিত্র ও বৈশিষ্ট্য ভারতে তেমনভাবে দেখা যায়নি। তবে একথা মানতেই হবে ১৮২০’র সময় থেকেই ভারতীয় সমাজে বেশ কিছু পরিবর্তন ঘটতে থাকে যা বিংশ শতাব্দীর প্রথম অর্ধেও পরিলক্ষিত হয়েছে। প্রভূত ব্যক্তিমনীষা ভারতীয় সমাজ জীবনের এই পরিবর্তনের অংশ নিয়েছেন, এঁদের মধ্যে রামমােহন ছিলেন পথপ্রদর্শক একথা স্বীকার না করলে, ইতিহাসকে অস্বীকার করা হবে।