চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত কি? চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সুফল ও কুফলগুলি আলোচনা করো ?
চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ব্যবস্থা প্রথম প্রস্তাবক ছিলেন স্কটিশ চিন্তাবিদ ও ইতিহাস আলেকজান্ডার ডাফ। ইংরেজ শাসিত কর্নওয়ালিস ১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দে ২১সে মার্চ সর
চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত
পটভুমি - চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ব্যবস্থা প্রথম প্রস্তাবক ছিলেন স্কটিশ চিন্তাবিদ ও ইতিহাস আলেকজান্ডার ডাফ। ইংরেজ শাসিত কর্নওয়ালিস ১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দে ২১সে মার্চ সর্বপ্রথম চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তন করেন। জে. সি. মার্শম্যানের মতে এই বন্দোবস্ত ছিল একটি দৃঢ় সাহসী ও বুদ্ধিদীপ্ত পদক্ষেপ। কি কারনের জন্য এই ব্যবস্থা গৃহীত হলো এবং চালু করা হলো তার নিচে আলোচনা করা হল।
১. রাজস্ব আদায়ের পরীক্ষা নিরীক্ষা - ১৭৬৫ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি দেওয়ানী লাভের পর থেকেই রাজস্ব আদাই বৃদ্ধির চেষ্টা শুরু করে। খুব সহজভাবে অথচ বেশি পরিমাণে কিভাবে রাজস্ব আদায় করা যায়? এই নিয়ে কোম্পানি বিভিন্ন ধরনের ভূমি ব্যবস্থার উদ্ভাবন নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষারই ফলশ্রুতি চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত।
২. সমকালীন অর্থনীতিবিদদের প্রভাব - চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের প্রথম প্রবক্তা আলেকজান্ডার ডাফ বাণিজ্যের উন্নতির লক্ষ্যে জমিতে ব্যক্তিগত মালিকানা প্রতিষ্ঠার পক্ষে মত প্রকাশ করেন তিনি বলেন রাজস্বের স্থায়ী বন্দোবস্ত করা গেলে কৃষি ব্যবস্থারও উন্নতি ঘটবে, আর কৃষির উন্নতি ঘটলে বাণিজ্য সমৃদ্ধি হবে। স্কটল্যান্ডের বিখ্যাত কৃষি কলাবিদ হেনরি পাত্তুলো প্রাকৃতিক সম্পদকেই আয়ের মূল উৎস বলে উল্লেখ করে জমিতে চিরস্থায়ী ব্যক্তিগত মালিকানা প্রতিষ্ঠার পক্ষে সওয়াল করেন।
৩. কোম্পানির সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের সমর্থন - ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মচারীদের গরিষ্ঠ অংশ দীর্ঘদিন ধরে জমিদারদের নির্ধারিত রাজস্ব চিরতরে নির্দিষ্ট করার পক্ষে দাবী জানিয়ে আসছিলেন। ওয়ারেন হেস্টিংস প্রথম পাঁচশালা বন্দোবস্ত প্রবর্তন করেন এবং তার সাথে প্রমুখ ও কর্মচারীবৃন্দ ভূমি রাজস্বের হার স্থায়ী করার দাবি তোলেন। তাদের এই দাবিতে তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী উইলিয়াম পিট ও কোম্পানির বোর্ড অফ কন্ট্রোল এর সভাপতি হেনরি জান্ত্রাস প্রভাবিত হন।
৪. পিটের আইন ও পরিচালক সভার প্রভাব - ১৭৮৪ খ্রিস্টাব্দে পিটের ভারত শাসন আইনে বারবার ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থার পরীক্ষা-নিরীক্ষার ক্ষতিকর প্রভাব কে লক্ষ্য রেখে জমিদারদের সঙ্গে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সুপারিশ করা হয়। এর দু'বছর পরে কোম্পানির পরিচালক সভা ঘনঘন রাজস্ব ব্যবস্থা পরিবর্তনের তীব্র সমালোচনা করে এবং লর্ড কর্নওয়ালিস কে বাংলায় স্থায়ীভাবে ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থা প্রবর্তনের লক্ষ্যে ভারতে পাঠায়।
৫. কর্নওয়ালিসের প্রচেষ্টা - গভর্নর জেনারেল হিসেবে ভারতে এসে লর্ড কর্নওয়ালিস রাজস্ব হার, জমির পরিমাণ প্রভৃতি বিষয়ে বিস্তৃত অনুসন্ধান চালান, অবশেষে তিনি বাংলা,বিহার এবং ওড়িশার জমিদারদের সঙ্গে ১০ বছরের জন্য জমি বন্দোবস্তের কথা ঘোষণা করেন, যা দশশালা বন্দোবস্ত নামে পরিচিত। পরিচালক সভার অনুমোদন পেয়ে দশশালা বন্দোবস্তকে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে রূপান্তরিত করা হয়। (১৭৯৩ খ্রিস্টাব্দে ২১সে মার্চ)
চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের শর্ত সমূহ - এই চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের শর্তাবলী ছিল নিম্নরূপ -
- বংশ পরস্পরায় জমি ভোগ দখল করে আসছেন এরূপ জমিদাররা বছরের নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সরকারকে খাজনা দিয়ে বংশানুক্রমিকভাবে জমির স্বত্ব ভোগ করতে পারবে।
- জমিদার বা ইজরাদাররা আদায় করা রাজস্বের কর ভাগ সরকারি কোষাগারে জমা দেবেন, একভাগ নিজেরা ভোগ করবেন।
- সূর্যাস্ত আইন অনুসারে বাংলা মাসের হিসেবে বছরের শেষ দিনে সূর্যাস্ত হওয়ার পূর্বেই বাকি রাজস্ব জমা দিতে হবে না হলে জমিদারি বাজেয়াপ্ত করা হবে।
- সুদূর ভবিষ্যতে কোন প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঘটলেও রাজস্বের ছাড় দেওয়া হবে না।
- জমিদাররা ভূমি রাজস্ব সংক্রান্ত কোনো বিবাদের বিচার করা অধিকার পাবে না।
- ভবিষ্যতে জমিদারদের আর বাড়লেও কোম্পানির আদায়কৃত নির্ধারিত রাজস্বের পরিমাণ অপরিবর্তিত থাকবে।
চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের উদ্দেশ্য - চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তনের মাধ্যমে কোম্পানি যে উদ্দেশ্য পূরণ করতে চেয়েছিলেন সেগুলি হল -
১. নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই রাজস্ব আদায় - বছরে নির্দিষ্ট সময়ে পূর্বনির্ধারিত রাজস্ব আদায় করার লক্ষ্যে কোম্পানি চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের প্রবর্তন ঘটায়। । জমিদাররা সূর্যাস্ত আইনের হাত থেকে জমিদারি রক্ষার লক্ষ্যে বছরের নির্দিষ্ট সময়ে তাদের নির্দিষ্ট পরিমাণ রাজস্ব জমা দিতে বাধ্য থাকেন।
২. অনুগত জমিদার সম্প্রদায় সৃষ্টি - কোম্পানি চেয়েছিল এই বন্দোবস্তের সুবাদে জমি নির্দিষ্ট মেয়াদ প্রদান করে একশ্রেণীর জমিদার তৈরি করতে, যারা কোম্পানির প্রতি আনুগত্যশীল থাকার। এরা বাংলায় কোম্পানির শাসনের সহযোগী হিসেবে কোম্পানি বিরোধীগণ অসন্তোষ গুলির সমাধানে সাহায্য করবে বলে আশা প্রকাশ করে কোম্পানি।
৩. স্থায়ী ভূমি রাজস্বের হার নির্ধারণ - কোম্পানি চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তনের মাধ্যমে স্থায়ীভাবে ভূমি রাজস্বের হার নির্ধারণ করতে চেয়েছিল। এক্ষেত্রে কোম্পানির লক্ষ্য ছিল। চিরতরে ভূমি রাজস্বের হার নির্ধারণ করে দিতে পারলে বছরের শেষে আদায়কৃত রাজস্বের পরিমাণ সম্পর্কে দুশ্চিন্তা দূর হবে। আর্থিক স্থিরতা আসলে ব্রিটিশ সরকার সুষ্ঠুভাবে নিশ্চিন্তে প্রশাসন পরিচালনা করতে পারবে।
৪. বাজেট তৈরি- ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ ভেবেছিল একবার ভূমি রাজস্বের হার স্থায়ীভাবে নির্ধারিত করে দিতে পারলে একদিকে যেমন বার্ষিক আয়ের পরিমাণ জানা যাবে, অপরদিকে ব্যয়ের পরিকল্পনা গ্রহণও সম্ভব হবে। এক কথায় বার্ষিক আয় ব্যয়ের হিসাব বা বাজেট তৈরি করতে সুবিধা হবে।
৫. নিলাম ব্যবস্থা থেকে মুক্তি - রাজস্ব ব্যবস্থার বিভিন্ন পর্বে মধ্যস্বত্ব ভোগীদের নিয়োগ করে কোম্পানি অনেক সময় রাজস্ব সংগ্রহ করত, অনেক সময় নিলাম ডাকের সময় যে অর্থ মূল্য উঠতো, তার সম্পূর্ণ অংশ কোম্পানির করে রাজস্ব হিসেবে জমা হতো না, এছাড়াও আদায় করা রাজস্বের পরিমাণ বছর আলাদা হওয়ায় জমিদার বা রায়ত কেউই চাষের উন্নতির দিকে নজর দিত না। আবার এই ব্যবস্থায় প্রতি বছর নতুন খাজনার হার নির্ধারিত হতো। নিলাম ব্যবস্থার এই ঝামেলা থেকেই রেহাই পাওয়ার জন্য কর্নওয়ালিস চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তন করেন ।
চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সুফল ও কুফল
চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত একটি বিতর্কিত ভূমি রাজস্ব ব্যবস্থা, যা ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কর্তৃক ১৭৯৩ সালে প্রবর্তিত হয়েছিল। এই ব্যবস্থার সুফল এবং কুফল উভয়ই ছিল। সুফলগুলো ছিল যেমন – জমির মালিকানা নিশ্চিত করা, রাজস্ব আদায়ের প্রক্রিয়া সহজ করা, এবং বিনিয়োগ বৃদ্ধি। অন্যদিকে কুফল ছিল – জমিদারদের ক্ষমতা বৃদ্ধি, কৃষকদের শোষণ, এবং ভূমি অর্থনীতির ভারসাম্যহীনতা।
সুফল:
- জমির মালিকানা নিশ্চিত: এই ব্যবস্থা জমিদারদের জমির মালিকানা নিশ্চিত করে এবং তাদের বংশানুক্রমিক অধিকার দেয়।
- রাজস্ব আদায়ের প্রক্রিয়া সহজ: জমিদারদের নির্দিষ্ট রাজস্ব প্রদান করতে হতো, যা রাজস্ব আদায়ের প্রক্রিয়া সহজ করে।
- বিনিয়োগ বৃদ্ধি: জমির মালিকানা নিশ্চিত হওয়ায় জমিদাররা বিনিয়োগ করতে উৎসাহিত হয়েছিল।
কুফল:
- জমিদারদের ক্ষমতা বৃদ্ধি: জমিদাররা তাদের ক্ষমতা ব্যবহার করে কৃষকদের শোষণ করতে শুরু করে।
- কৃষকদের শোষণ: জমিদাররা কৃষকদের কাছ থেকে অতিরিক্ত রাজস্ব আদায় করত, যার ফলে কৃষকরা তাদের অধিকার হারায়।
- ভূমি অর্থনীতির ভারসাম্যহীনতা: এই ব্যবস্থা ভূমি অর্থনীতির ভারসাম্যহীনতা সৃষ্টি করে, যেখানে জমিদাররা সুবিধা পায় এবং কৃষকরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
মুল্যায়নঃ-
পরিশেষে বলা যায় যে, চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত আইন এখন স্পষ্টভাবে বোঝা যাচ্ছে। বলা যেতে পারে যে এই আইন অনুসারে জমিদাররা বাংলার জমিদারি সম্পত্তির স্বাধীন মালিক হিসেবে ঔপনিবেশিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় প্রবেশাধিকার পেয়েছিলেন এবং সরকারকে যে রাজস্ব প্রদান করা হত তা স্থায়ীভাবে নির্ধারিত হয়েছিল। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সুফল গুলি শুধুমাত্র ইংরেজদের জন্যই ছিল। অন্যদিকে,এর কুফল গুলি পরেছিল ভারতীয় জনসমাজের উপর। এই ব্যবস্থার মাধ্যমে ভারতীয় কৃষকদের কোন দুঃখমোচন হয়নি বরং তাদের দুঃখ বেড়েছিল। আইনটি জমিদারদের উপর নানাভাবে প্রভাব ফেলেছিল। আইনটি যে বছর প্রণীত হয়েছিল, আইনের উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য এবং আইনের প্রভাব সম্পর্কেও উপরে আলোচনা করা হয়েছে। এ ছাড়াও, আইনে যেসব সংশোধনী আনা হয়েছিল এবং কীভাবে তারা তখন জীবনকে বদলে দিয়েছিল তা নিয়েও আলোচনা করা হয়েছে। সুতরাং, এই সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় যে স্থায়ী বন্দোবস্ত আইনের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দিক উপরে আলোচনা করা হয়েছে।
তথ্যসুত্রঃ -
- "Cornwallis Code"। Encyclopedia Britannica। ৪ ফেব্রুয়ারি ২০০৯। সংগ্রহের তারিখ ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৭।
- ↑ "Colonialism and the Countryside"। Themes in Indian History III (পিডিএফ)। National Council of Educational Research & Training। ২০১৭ [First published 2007]। পৃষ্ঠা 258–259। আইএসবিএন 978-81-7450-770-9।
- ↑ Minutes of evidence taken before the select committee on the affairs of the East India Company: and also an appendix and index : III. Revenue (ইংরেজি ভাষায়)। ১৮৩২। পৃষ্ঠা 208–209।
- ↑ Keith, Arthur Berriedale (১৯২২)। Speeches & documents on Indian policy, 1750-1921। Kelly - University of Toronto। London Oxford University Press। পৃষ্ঠা 215।
- ↑ Cohn, Bernard S. (আগস্ট ১৯৬০)। "The Initial British Impact on India: A case study of the Benares region"। The Journal of Asian Studies। Association for Asian Studies। 19 (4): 418–431। এসটুসিআইডি 154726821। জেস্টোর 2943581। ডিওআই:10.2307/2943581।
এই আর্টিকেলগুলো পড়ে কেমন লাগলো তা জানাতে অবশ্যই নিচে কমেন্ট করুন!
আপনাদের মূল্যবান মতামত ও মন্তব্যই আমাদের পথচলার অনুপ্রেরণা। আপনার প্রতিটি কমেন্ট আমাদের উৎসাহ যোগায় আরও তথ্যবহুল ও মানসম্পন্ন কন্টেন্ট উপহার দেওয়ার জন্য। তাই নির্দ্বিধায় আপনার মতামত শেয়ার করুন — আমরা অপেক্ষায় আছি আপনার মূল্যবান কথাগুলোর।