ঐতিহাসিক উপাদান কাকে বলে? প্রাচীন যুগে ভারত-ইতিহাস রচনায় যে-কোনাে একটি উপাদান সম্পর্কে আলােচনা করাে।অথবা, প্রাচীন ভারতের ইতিহাস রচনায় প্রত্নতাত্ত্বিক ও লিখিত উপাদানের একটি সংক্ষিপ্ত বিবরণ দাও।
প্রাচীন ভারতের ইতিহাস রচনার বিভিন্ন উপাদানের শ্রেণিবিভাগ: প্রাচীন যুগের ভারতের ইতিহাস রচনার ঐতিহাসিক উপাদানগুলিকে প্রধানত দুটি শ্রেণিতে ভাগ করা যায়, যথা :
ক) প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদান
খ) সাহিত্যিক উপাদান।
[ক] প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদান ; - ইতিহাস রচনার জন্য সাহিত্যের তুলনায় প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদানের গুরুত্ব অনেক বেশি।প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদানগুলিকে তিন ভাগে ভাগ করা যায়, যেমন :
১) লিপি,
(২) মুদ্রা, এবং
৩) স্থাপত্য ও ভাস্কর্য।
[১] লিপি : প্রাচীন ভারতের ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে প্রাচীন লিপি হল একটি মূল্যবান উপাদান। পাথর, তামা, লােহা, ব্রোঞ্জ ও পােড়ামাটির ওপর প্রাচীন ভারতের উৎকীর্ণ লিপি থেকে তৎকালীন রাজনৈতিক, আর্থসামাজিক এবং ধর্মীয় জীবনযাত্রার পরিচয় পাওয়া যায়। এই কারণেই লিপিকে ইতিহাসের জীবন্ত দলিল বলা যেতে পারে, কেননা কালভেদে সাহিত্যের ভাষাও বক্তব্যের পরিবর্তন ঘটলেও লিপি সবসময়েই অপরিবর্তিত থাকে।
ক) দেশীয় লিপি : ভারতীয় রাজাদের রাজ্যজয়, রাজপ্রশস্তি, ভূমিদান, শাসন, ধর্ম, রাজনৈতিক ঘটনা, ব্যাবসাবাণিজ্য প্রভৃতি বিষয় ছিল ব্রাত্মী, খরােষ্ঠী, তামিল, পালি, সংস্কৃত, প্রাকৃত প্রভৃতি বহু ভাষায় লেখা প্রাচীন ভারতীয় লিপিগুলির প্রধান বিষয়বস্তু (এদের মধ্যে প্রাচীন ভারতের লিপিগুলির মধ্যে অশােকের লিপিই ছিল অন্যতম)। এছাড়াও সমুদ্রগুপ্তের এলাহাবাদ প্রশস্তি, সাতবাহন রাজ গৌতমীপুত্র সাতকর্ণীর নাসিক প্রশক্তি, চালুক্যরাজ দ্বিতীয় পুলকেশীর ‘আইহােল লিপি, রুদ্রদামনের জুনাগড় শিলালিপি, কলিঙ্গরাজের হস্তিগুম্ফা লিপিও বিশেষ উল্লেখযােগ্য।
খ) বিদেশি লিপি : এশিয়া মাইনর, (বােখাজ কোই’ নামক স্থানে) কম্বােডিয়া, চম্পা, যবদ্বীপ গ্রিস ও পারস্য (পার্সেপােলিস, বেহিস্থান, নক্স-ই রুস্তম প্রভৃতি স্থান) প্রভৃতি বৈদেশিক অঞ্চলগুলি থেকে পাওয়া লিপিগুলাে থেকে এইসব অঞ্চলের সঙ্গে প্রাচীন ভারতের সাংস্কৃতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্কের হদিশ পাওয়া যায়।
[২] মুদ্রা : প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদানগুলির মধ্যে মুদ্রার গুরুত্ব অপরিসীম। সাহিত্য ও লিপি থেকে যেসব তথ্য সংগ্রহ করা যায় তার সত্যতা যাচাই করার জন্য মুদ্রার বিশেষ উপযােগিতা রয়েছে। প্রাচীন ভারতে নিষ্ক’বা মনা’ নামে মুদ্রা ব্যবহৃত হলেও গ্রিক, শক, কুষাণ, পাল, প্রতিহার ও রাষ্ট্রকূট বংশের আমলেই মুদ্রার প্রচলন বেশি ঘটে। প্রাচীনকালের ভারতীয় মুদ্রাগুলাে সাধারণত সােনা, রুপা, তামা, ব্রোঞ্জ, সিসা এমনকি মাটি পুড়িয়েও তৈরি করা হত। গ্রিক আক্রমণের পর থেকেই ভারতে রাজার নাম খােদাই করা মুদ্রা ব্যবহারের প্রচলন হয়।
প্রাচীন মুদ্রা থেকে
১) কোনাে রাজ্যের রাজার নাম,
২) সাল,
৩) তারিখ,
৪) তৎকালীন সময়ের রাজনৈতিক, আর্থিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাস,
৫) রাজ্যের ভৌগােলিক সীমা,
৬) ধর্মবিশ্বাস,
৭) সামাজিক অবস্থা,
৮) বৈদেশিক বাণিজ্য প্রভৃতি সম্পর্কে নানান তথ্য নির্ভুলভাবে জানা যায়।
৯) এমনকি প্রাচীন মুদ্রা থেকে রাজ্যটি রাজতান্ত্রিক কিংবা প্রজাতান্ত্রিক (যেমন শক ও পল্লব যুগ) সে বিষয়েও তথ্য পাওয়া যায়।
১০) কোনাে কোনাে মুদ্রায় অঙ্কিত ছবি থেকে সেই রাজার ব্যক্তিগত গুণাবলির প্রতিফলন পাওয়া যায়।
[৩] স্থাপত্য ও ভাস্কর্য : মাটির নীচে খননকার্যের মাধ্যমে যে সমস্ত মূর্তি, মন্দির, বাড়িঘর, নগর, সমাধি, আসবাবপত্র প্রভৃতি প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন পাওয়া যায়, সাধারণভাবে তা স্থাপত্য-ভাস্কর্য নামে পরিচিত। রাজনৈতিক ইতিহাসের ক্ষেত্রে অপ্রয়ােজনীয় হলেও শিল্প-সংস্কৃতি তথা সামাজিক ও ধর্মীয় ইতিহাসের ক্ষেত্রে স্থাপত্য ও ভাস্কর্যের অপরিসীম গুরুত্ব রয়েছে (যেমন, মেহেরগড়, হরপ্পা ও মহেঞ্জোদাড়াে প্রভৃতি সুপ্রাচীন অঞ্চলে প্রাপ্ত স্থাপত্য ও ভাস্কর্য)।
এছাড়া—গুজরাট, রাজস্থান, হরিয়ানা, সাঁচী, সারনাথ, পাটলিপুত্র, রাজগীর, নালন্দা এবং বাংলায় পাহাড়পুর ও সাম্প্রতিককালে চন্দ্রকেতুগড়ে মূল্যবান প্রত্নতাত্ত্বিক ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কৃত হয়েছে।
[খ] সাহিত্যিক উপাদান ; গুরুত্বের বিচারে ভারতীয় সাহিত্যের উপাদানগুলি দুই ভাগে বিভক্ত যথা :
১) দেশীয় সাহিত্য,
২) বৈদেশিক বিবরণ।
[১] দেশীয় সাহিত্য : দেশীয় সাহিত্যগুলিকে প্রধানত ৪টি ভাগে বিভক্ত করা যায়, যথা :
ক) ধর্মীয় গ্রন্থ,
খ) ধর্মনিরপেক্ষ গ্রন্থ,
গ) জীবনচরিত এবং
ঘ) আঞ্চলিক ইতিহাস।
ক ) ধর্মীয় গ্রন্থ : প্রাচীন ভারতের অধিকাংশ গ্রন্থই ধর্মকে ভিত্তি করে লেখা। প্রাচীন ভারতের হিন্দুধর্মের গ্রন্থগুলির মধ্যে উল্লেখযােগ্য হল : বেদ, উপনিষদ, পুরাণ, রামায়ণ, মহাভারত প্রভৃতি। প্রাচীন ভারতের উল্লেখযােগ্য বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থ হল : ত্রিপিটকও জাতক এবং জৈন ধর্মগ্রন্থ হল : কল্পসূত্র, পরিশিষ্ট পর্ব প্রভৃতি।
খ) ধর্মনিরপেক্ষ গ্রন্থ : প্রাচীন ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ গ্রন্থগুলাে আইন, বিজ্ঞান, জ্যোতির্বিদ্যা, ব্যাকরণ প্রভৃতি বিষয়কে ভিত্তি করে লেখা হয়েছিল। এইসব গ্রন্থগুলাের মধ্যে কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র পাণিনির অষ্টাধ্যায়ী পতঞ্জলির মহাভাষ্য’ প্রভৃতি উল্লেখযােগ্য।
গ ) জীবনচরিত : প্রাচীন ভারতের বিভিন্ন রাজাদের জীবনচরিতের মধ্যে বাণভট্টের হর্ষচরিত, বিলহণের ‘ ক্রিমাঙ্কদেব চরিত; সন্ধ্যাকর নন্দীর রামচরিত’প্রভৃতি বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য।
ঘ) আঞ্চলিক ইতিহাস : স্থানীয় বা আঞ্চলিকভাবে রচিত গ্রন্থের মধ্যে কাশ্মীরের ওপর লিখিত কলহনের রাজতরঙ্গিনী' গ্রন্থটি সবচেয়ে প্রসিদ্ধ। সােমেশ্বর রচিত রাসমালা’ এবং রাজশেখর রচিত প্রবন্ধকোষ থেকে প্রাচীন গুজরাটের রাজনৈতিক ইতিহাস জানা যায়।
[২] বৈদেশিক বিবরণ : ভারতে আসা বিদেশি লেখক ও সাহিত্যিকদের বিবরণ থেকে ভারতীয় ইতিহাস সম্পর্কে যেসব তথ্য পাওয়া যায়, সেগুলিকে বৈদেশিক বিবরণ বলা যায়।
প্রাচীন ভারতের ইতিহাসের বৈদেশিক উপাদানগুলাের মধ্যে গ্রিক দূত মেগাস্থিনিসের ইন্ডিকা’(মৌর্যযুগ), ফা-হিয়েন (গুপ্তযুগ), হিউয়েন সাঙ (হর্ষবর্ধনের আমল) প্রমুখ পর্যটকদের বিবরণও উল্লেখযােগ্য। মধ্যযুগে ভারতে আসা মুসলিম পর্যটকদের মধ্যে আলবেরুনী ও আলমামুদির নাম বিশেষভাবে অগ্রগণ্য। আলবেরুনী রচিত “তহকিক-ই-হিন্দ” গ্রন্থে একাদশ শতকের ভারতের ধর্ম, সমাজ, শিক্ষা ও বিজ্ঞানচর্চার নির্ভরযােগ্য তথ্য জানা যায়।
◆ উপসংহার - উপরিউক্ত আলােচনার পরিশেষে বলা যায় যে, লিখিত ও প্রত্নতাত্ত্বিক দু'ধরনের উপাদানের মধ্যে কোটি বেশি গুরুত্বপূর্ণ তা বলা অত্যন্ত কঠিন। কোনাে যুগে সাহিত্যিক উপাদানের উপযােগিতা বেশি, আবার অন্য কোনাে যুগে প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদানের ওপরই একান্তভাবে নির্ভর করতে হয়। তবে প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদানের বিশ্বাসযােগ্যতা যে তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি, তা বলাই বাহুল্য।