তুর্কি-আক্রমণ বাংলা সাহিত্যে কী প্রভাব ফেলেছিল আলােচনা করাে।

তুর্কি-আক্রমণের প্রভাব: তুর্কি-আক্রমণের ফলে বাংলার সমাজজীবনে যে অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তা দেখা দেয়, তা সাহিত্যসৃষ্টির প্রতিকূল ছিল। সাহিত্যের ইতিহাসে তাই আনুমানিক ১২০৩ থেকে ১৩৫০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সময়কে ‘ নিষ্ফলা যুগ’ বা ‘অন্ধকার যুগ' নামে অভিহিত করা হয়। ১৩৪২ খ্রিস্টাব্দে ইলিয়াস শাহি রাজবংশের সূচনা ঘটলে বাংলা দেশে আবার স্বাভাবিক পরিবেশ ফিরে আসে—ক্রমশ অন্ধকার যুগের অবসান ঘটে। আপাতভাবে তুর্কি আক্রমণের পরবর্তী সময়ে সাহিত্য সৃষ্টি না হলেও এর দূরাগত প্রভাব ছিল যথেষ্টই।

১) বর্গসম্মিলনের সূত্র ধরে অনার্য দেবদেবীদের আর্যীকরণের যে প্রক্রিয়া শুরু হয় তার ফলেই সৃষ্টি হয় মঙ্গলকাব্যগুলির। লৌকিক পরিমণ্ডলে কথ্য আঙ্গিকে মনসা, চণ্ডী ইত্যাদি দেবদেবীর যেসব বন্দনাগান প্রচলিত ছিল—সেগুলি লিখিত রূপ পায় বিভিন্ন মঙ্গলকাব্যে।

২) সাধারণ মানুষ পৌরাণিক দেবদেবীদের পূজা-অর্চনার অধিকার পাওয়ায় সূচনা হল অনুবাদ সাহিত্যের, যার মূল উদ্দেশ্য এইসব দেবতাদের মাহাত্ম্যের সঙ্গে লােকসাধারণের প্রত্যক্ষ সংযােগ ঘটানাে। এভাবেই রামায়ণ, মহাভারত, ভাগবতের অনুবাদে সমৃদ্ধ হল বাংলা সাহিত্য।

৩) তুর্কি আক্রমণের ফলে সমাজ-মানসিকতার যে বদল ঘটে তার ফলে সাহিত্যে প্রতিষ্ঠা পায় লৌকিকতা। বড় চণ্ডীদাসের ‘আভীর’ কৃয় এই লৌকিকতারই ফল। কৃত্তিবাসের বাঙালিয়ানাতেও আর-একভাবে আসে এই লৌকিকতা।

৪) তুর্কি আক্রমণ চৈতন্যদেবের আবির্ভাবকে ত্বরান্বিত করে। হিন্দু রক্ষণশীলতার দুর্গে ফাটল ধরে, মিশ্র সংস্কৃতির পথ ধরেই ঘটে চৈতন্যের আগমন। আবার এই পথেই সুফিধর্মের যে বিকাশ ঘটে তা বাংলা সাহিত্যে বাউল ভাবধারার জন্ম দেয়।

এভাবেই তুর্কি আক্রমণ আপাতভাবে নিষ্ফলা হলেও বাংলা সাহিত্যে তার সুদূরবিস্তৃত প্রভাব রাখতে সমর্থ হয়।
Write Your HideComments
Cancel

Please Do Not Enter Any Span Link in The Comment Box