তুর্কি বিজয় বাঙালি সমাজে কী প্রভাব ফেলেছিল আলােচনা করাে।
● সমাজজীবনে তুর্কি-বিজয়ের প্রত্যক্ষ প্রভাব : তুর্কিরা ছিল ভিন্ন দেশ, জাতি ও ধর্মের মানুষ। বাংলার জীবনযাত্রা বা ঐতিহ্যের সঙ্গে তাদের কোনাে যােগ ছিল না; তার ওপর তারা ছিল অত্যাচারী এবং লুণ্ঠনপ্রিয়। বখতিয়ার খিলজির নেতৃত্বে ১২০৩ খ্রিস্টাব্দে তুর্কিদের অভিযান তাই বাংলার রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক ক্ষেত্রে নিদারুণ অভিশাপ হয়ে নেমে আসে। দেশের সর্বত্র দেখা দেয় চরম অরাজকতা ও অনিশ্চয়তা—তুর্কিদের হাতে ধ্বংস হয় বহু হিন্দু মন্দির, বৌদ্ধ বিহার এবং আরও অনেক ধর্মীয় নিদর্শন, অসংখ্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, গ্রন্থাগার এবং বহু মূল্যবান পুথিপত্র। নির্মম অত্যাচার ও শােষণে সাধারণ মানুষের জীবন অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে, প্রাণের ভয়ে কিংবা ধর্মরক্ষার তাগিদে অনেকে দেশ ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতে থাকেন। অস্তিত্ব রক্ষার প্রয়ােজনে অনেকের মধ্যে এই সময়ে ইসলামধর্ম গ্রহণের প্রবণতাও দেখা দেয়।
● সমাজজীবনে তুর্কি-বিজয়ের পরোক্ষ প্রভাব :
১) বর্গসম্মিলন: তুর্কি-বিজয়ের ফলে বর্ণহিন্দুদের অপ্রতিহত সামাজিক আধিপত্য বিনষ্ট হয়। আত্মরক্ষার প্রয়ােজনে অনার্য জাতিগােষ্ঠীগুলি, যাদের এতদিন অস্পৃশ্য করে রাখা হয়েছিল, তাদের সঙ্গে সংযােগ তৈরি করা অনিবার্য হয়ে ওঠে। মনসা, চণ্ডীর মতাে অনার্য দেবীরা ব্রাত্মণ্যতন্ত্রে প্রবেশাধিকার পায়।
২) সাংস্কৃতিক প্রতিরোধ : বহিরাগত শক্তিকে প্রতিরােধের জন্য তৈরি করা হয় ঐক্যবদ্ধ সাংস্কৃতিক প্রতিরােধ। এই প্রতিরােধের অংশ হিসেবে অনার্য দেবীরা যেমন বর্ণহিন্দুদের দ্বারা পূজিত হয়, সেভাবেই উচ্চবর্ণের আরাধ্য পৌরাণিক দেবদেবীরা লােকচরিত্র লাভ করে।
৩) সমাজ-সংস্কৃতির নতুন প্রেক্ষাপট : সাময়িক অনিশ্চয়তার অবসানে হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতির সূত্র ধরে তৈরি হয় সমাজ-সংস্কৃতির এক নতুন প্রেক্ষাপট। রুউদ্দিন বরবক্ শাহ্ ভাগবতের অনুবাদে পৃষ্ঠপােষকতা করেন। হুসেন শাহ্ এই মিশ্র সংস্কৃতিকে উচ্চতায় পৌঁছে দেন; গৌড় মল্লিক ছিলেন তাঁর প্রধান সেনাপতি। পরাগল খাঁর পৃষ্ঠপােষকতায় মহাভারতের যে অনুবাদ কবীন্দ্র পরমেশ্বর করেছিলেন, সেখানেও হুসেন শাহ্ এবং তাঁর পুত্র নসরৎ শাহের বিশেষ অবদান ছিল। এইভাবেই তুর্কি-আক্রমণ ও তুর্কি-বিজয় বাংলা দেশের সমাজজীবনে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলেছিল।