চর্যাপদের বিষয়বস্তুর উল্লেখসহ তার সাহিত্যমূল্যের পরিচয় দাও। অথবা, চর্যাপদ’-এর সাহিত্যমূল্য বিচার করাে।

চর্যাপদ-এর সাহিত্যমূল্য : বিশুদ্ধ সাহিত্যসৃষ্টির অভিপ্রায় নিয়ে চর্যাপদ রচিত হয়নি। সহজিয়া পন্থী নামে পরিচিত এক শ্রেণির বৌদ্ধ সাধক তাঁদের সাধনার গুঢ় তত্ত্বকে রূপক ও সংকেতের সাহায্যে ব্যক্ত করতে চেয়েছেন এগুলির মধ্যে। চর্যাপদ’ মুখ্যত ধর্মবিষয়ক রচনা হওয়া সত্ত্বেও চর্যার গানগুলির সাহিত্যমূল্য’ একেবারে উপেক্ষণীয় নয়। কারণ, পরিচিত লৌকিক জীবনের আধারে সেই ধর্মকথা পরিবেশিত হওয়ায়, ধর্মীয় রহস্য না জেনেও ‘চর্যাপদ আস্বাদন করা সম্ভব।

◆ বহু বিচিত্র অনুভব ও অভিজ্ঞতার প্রতিফলন লক্ষ করা যায় ‘চর্যাপদ’-এ। এর কোনাে কোনােটি চিরকালীন মানবিক আবেদনের রসে সিক্ত।
কুক্কুরীপাদ রচিত একটি পদে আছে—  

“হাঁউ নিরাসী খমন ভরে। 
মােহাের বিগােআ কহণ ন জাই।। 
ফেটলিউ গাে মাএ অন্তউড়ি চাহি।
জা এথু চাহাম সাে এথু নাহি।।”

এর সরলার্থ করলে দাঁড়ায়; সন্ন্যাসী স্বামীর কাছে আমি নিরাশ হয়েছি। আমার সুখের কথা আর বলতে পারি । মা গাে, আমি প্রসব করেছি, এখন দরকার একটি আঁতুড়ঘরের। কিন্তু এখানে যা চাই তা পাই না। দুঃখিনী নারীর এই কাতর আর্তি একালের পাঠকের মনকেও ছুঁয়ে যায়। ঢেণঢণপাদ রচিত একটি পদে দেখতে পাই নিঃসঙ্গ অথচ বিড়ম্বিত জীবনের বেদনা ---

“টালত মাের ঘর নাহি পড়বেষী।
হাড়ীত ভাত নাহি নিতি আবেশী।”

‘প্রতিবেশীহীন টিলার ওপরে আমার ঘর। হাঁড়িতে ভাত নেই অথচ অতিথির নিত্য আনাগােনা। এই ধরনের পদগুলিতে যেমন দুঃখ-বেদনার কথা প্রকাশিত, তেমনি কোনাে কোনাে পদে প্রকাশ পায় রূপমুগ্ধতা ও মিলনের নিবিড় আগ্রহ। সেদিক থেকে শবরপাদের একটি রচনায় পাহাড়চূড়াবাসিনী এক শবরী বালিকার বর্ণনা খুব সহজেই দৃষ্টি আকর্ষণ করে।

“উঁচা উঁচা পাবত উঁহি বসই সবরী বালী।
মােরঙ্গি পীচ্ছ পরহিণ সবরী গিবত গুঞ্জরী মালী৷৷”

পাহাড়ি পরিবেশে অঙ্কিত এই শবরী বালিকার ছবি রসিকচিত্তে সগৌরবে স্থান করে নেয়। এ ছাড়াও এই গ্রন্থে এমন অনেক ব্যঞ্জনাগর্ভ পঙক্তি ও খণ্ডচিত্রের সন্ধান পাওয়া যায় যেগুলির সাহিত্যমূল্য অস্বীকার করার উপায় নেই।
‘চর্যাপদগুলি মূলত গান। সেজন্য ছন্দের ক্ষেত্রে কোথাও কোথাও শিথিলতা আছে। তা সত্ত্বেও  পাদাকুলক ছন্দের আদর্শকে যথাসম্ভ অনুসরণের চেষ্টা লক্ষ করা যায়। যেমন—

“আ-ঙ্গণ। ঘরপণ ।। সুন ভাে-। বিআতী।
কা-নেট। চৌরি ।। নিল অধ। রাতী ।।” 

ছাড়াও দোহা ও চউপইআ জাতীয় ছন্দোবন্ধের নিদর্শন পাওয়া যায় চর্যাপদে। কাজেই আঙ্গিক পদকর্তারা সচেতন ছিলেন, এ কথা বলা যেতে পারে।
সব মিলিয়ে ‘চর্যাপদ’কে উৎকৃষ্ট মানের কাব্যের মর্যাদা হয়তাে দেওয়া যাবে না, তবু বলা যায়, ধর্মতত্ত্বের ভেদ করেও তার মধ্যে কাব্যরসের উৎসধারা প্রবাহিত হয়েছে।
Write Your HideComments
Cancel

Please Do Not Enter Any Span Link in The Comment Box