চর্যাপদ’-এ সমকালীন সমাজজীবনের কীরূপ পরিচয় মেলে, তা আলােচনা করাে।
◆ চর্যাপদ'-এর সমকালীন সমাজজীবন: বিশুদ্ধ সাহিত্যসৃষ্টির অভিপ্রায় নিয়ে চর্যাপদ রচিত না হলেও চর্যাপদের কবিগণ বাস্তব জীবনের বিভিন্ন চিত্র রূপক হিসেবে ব্যবহার করেছেন তাঁদের রচনায়। সেজন্য চর্যাপদ থেকে তৎকালীন সমাজ ও জীবন সম্পর্কে অনেক কথা জানতে পারা যায়।
‘চর্যাপদ’-এর যুগে সমাজে শ্রেণিবিভাগ ছিল। তবে পদগুলিতে নিম্নবর্গীয় মানুষের জীবনযাপন সংক্রান্ত তথ্যই প্রতিফলিত হয়েছে বেশি। নগর বাহিরি রে ডােম্বি তােহােরি কুড়িআ’, ‘উঁচা উচা পাবত তঁহি বসই সবরী বালী’ কিংবা টালত মাের ঘর নাহি পড়বেষী’ প্রভৃতি উদ্ধৃতি থেকে জানা যায়, ডােম-শবরদের মতাে নিম্নশ্রেণির মানুষ বাস করত সাধারণ জনবসতি থেকে দূরে। উচ্চবর্ণের মানুষেরা এইসব নিম্নবর্ণের মানুষদের সংস্পর্শ বাঁচিয়ে চলার চেষ্টা করত। প্রাচীন বাংলার মানুষের যে কয়েকটি জীবিকার উল্লেখ আছে এই গ্রন্থে, তা হল তাত বােনা, চাঙারি তৈরি, পশুশিকার, নৌকা বাওয়া, মাছ ধরা, মদ তৈরি ও বিক্রি, গাছ কাটা প্রভৃতি। প্রধান খাদ্য ছিল ভাত; অন্যান্য আহার্য বস্তু হিসেবে দুধ, মাছ ও মাংসের উল্লেখ পাওয়া যায়। সেকালে একান্নবর্তী পরিবারগুলির দৈনন্দিন জীবনের প্রয়ােজনীয় উপকরণরূপে ব্যবহৃত হত হাঁড়ি, ঘড়া, কুঠার, টাঙি, আরশি, তালাচাবি প্রভৃতি।
চর্যাপদ’-এর যুগে বাজনা বাজিয়ে বরের বিবাহ করতে যাওয়ার প্রচলন ছিল; এমনকি যৌতুক প্রথারও উল্লেখ পাওয়া যায়। সামাজিক উৎসব-অনুষ্ঠানের অঙ্গ হিসেবে নাচ, গান ও অভিনয়ের যে প্রচলন ছিল; একটি পদে তার প্রমাণ পাওয়া যায়
“নাচন্তি বাজিল গান্তি দেবী।
বুদ্ধ নাটক বিষমা হােই।।”
মাদল, পটহ, ডমরু, বাঁশি, একতারা, বীণা প্রভৃতি বাদ্যযন্ত্র ছিল সেকালে। অবসর বিনােদনের জন্য নববল’ বা দাবা খেলা হত, কপূর সহযােগে পান খাওয়া ছিল বিশেষ বিলাসিতা।
চর্যাপদ’-এর সমকালে দেশে চোর-ডাকাতের যেমন উপদ্রব ছিল, তেমনি সতর্কমূলক ব্যবস্থাও ছিল। ঘরে তালাচাবি দেওয়ার ব্যবস্থা তাে ছিলই, সেই সঙ্গে প্রহরা ও শাস্তিবিধানেরও যে ব্যবস্থা ছিল, ‘উআরি (কাছারি), ‘দুষাধি’ (কোটাল), ‘প্রহরী' প্রভৃতি শব্দপ্রয়ােগে তারই ইঙ্গিত পাওয়া যায়।