বাংলা ভাষার বিকাশের আগে বাঙালি কবিদের সাহিত্যচর্চার সংক্ষিপ্ত বিবরণ দাও।
● সাহিত্যচর্চা: আনুমানিক সপ্তম-অষ্টম শতাব্দীতে মাগধী অপভ্রংশ ভাষা থেকে বাংলা ভাষার জন্ম হয়েছিল। অথচ প্রাচীন যুগের (দ্বাদশ শতাব্দী অবধি) বাংলা সাহিত্যের একমাত্র নিদর্শন হল ‘চর্যাচর্যবিনিশ্চয়’ অর্থাৎ চর্যাপদ। মধ্যযুগের আগে অর্থাৎ বাংলা ভাষার বিকাশের আগেও কিন্তু বাঙালিজাতি সাহিত্যচর্চা করেছে। তার প্রমাণ হল সংস্কৃত, প্রাকৃত এবং অপভ্রংশ সাহিত্য।
● সংস্কৃত সাহিত্য : খ্রিস্টীয় পঞ্চম শতাব্দী থেকে দ্বাদশ শতাব্দী পর্যন্ত সংস্কৃত ভাষা, স্মৃতি-পুরাণ, ন্যায়দর্শন, ব্যাকরণ অভিধান বাংলা দেশে বিশেষভাবে চর্চিত হত। তবে বাংলা দেশে বাঙালির লেখা প্রথম গ্রন্থ হল অভিনন্দের রামচরিত', যা রামচন্দ্রের উত্তরজীবনের কাহিনি অবলম্বনে রচিত (অষ্টম শতাব্দী)। দশম শতাব্দীতে রামপালের পুত্র মদনপালের অনুচর সন্ধ্যাকর নন্দী ওই একই নামে একটি কাব্য রচনা করেন যাতে একাধারে রামায়ণ কাহিনি এবং রামপাল ও তার বংশধরদের ইতিহাস বর্ণিত হয়েছে। লক্ষ্মণসেনের সভাকবি ধােয়ীর ‘পবনদূত’ কাব্য কালিদাসের মেঘদূত’ অনুসরণে লেখা দূতকাব্যগুলির (পদাকদূত’, ‘ভ্রমরদূত’ ইত্যাদি) মধ্যে শ্রেষ্ঠ। প্রাকৃত কাব্য-অনুসরণে লেখা গােবর্ধন আচার্যের ‘আর্যাসপ্তশতী’ কাব্য প্রায় সাতশাে আদিরসাত্মক কবিতার সমষ্টি। তবে, প্রাচীন যুগের শ্রেষ্ঠ বাঙালি কবি জয়দেব অমর হয়ে আছেন সংস্কৃত ভাষায় রচিত তাঁর রাধা-কৃয়-লীলা-বিষয়ক-নাট্যকাব্য ‘গীতগােবিন্দম্-এর জন্য। এ ছাড়াও বিদ্যাধর সংকলিত ‘সুভাষিত রত্নকোষ’ বা ‘কবীন্দ্রবচন-সমুচ্চয়’ এবং শ্রীধরদাস সংকলিত ‘সদুক্তি-কর্ণামৃত (১২০৬ খ্রিস্টাব্দ)—এই দুই সংস্কৃত সংকলনে বহু সংখ্যক বাঙালি কবির কাব্যচর্চার পরিচয় পাওয়া যায়।
● প্রাকৃত এবং অপভ্রংশ সাহিত্য : প্রাচীন যুগের কোনাে বাঙালি কবির প্রাকৃত বা অপভ্রংশ ভাষায় রচিত কোনাে গ্রন্থ এখনও আবিষ্কৃত হয়নি। কিন্তু প্রাকৃত ভাষায় লেখা গাথাসত্তসই’ এবং প্রাকৃত পৈঙ্গল’—এই দুই সংকলনের বেশ কিছু কবিতায় আমরা সমকালীন বাঙালি-জীবনের পরিচয় পাই। ‘ডাকার্ণব’, ‘দোহাকোষ-পঞ্জিকা প্রভৃতি অপভ্রংশ ভাষায় লেখা সংকলন গ্রন্থগুলির বেশির ভাগ লেখকই ছিলেন সহজিয়া-বৌদ্ধ বাঙালি।
প্রাচীন যুগের এই অবাংলা সাহিত্যের হাত ধরেই মধ্যযুগে এসে বাংলা সাহিত্য যথার্থভাবে বিকশিত
হয়েছিল।