সমাজ সংস্কারে রাজা রামমোহন রায়ের অবদান আলোচনা কর ।
সমাজ সংস্কারে রাজা রামমোহন রায়ের
অবদান :
ভূমিকা: মোগল সাম্রাজ্যের
পতনের পর রাজনৈতিক আবর্তে বাংলার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনে অন্ধকার ঘনিয়ে এসেছিল
এবং নানা কুসংস্কারের চাপে সমাজের স্বাভাবিক ধারা রুদ্ধ হয়ে গিয়েছিল । উনবিংশ শতকের
প্রথমার্ধে পাশ্চাত্য শিক্ষা, সংস্কৃতি ও সভ্যতার সংস্পর্শে এসে বাংলার সামাজিক, সাংস্কৃতিক
ও ধর্মীয় জীবনে পুনরায় যে নতুন জাগরণ সৃষ্টি হয়, তাকেই বাংলার নবজাগরণ বলা হয় । পঞ্চদশ
শতাব্দিতে ইটালিতে যে নবজাগরণ হয় তা যেমন কালে কালে সমগ্র ইউরোপে পরিব্যাপ্ত হয়েছিল
বাংলার নবজাগরণ তেমনি ক্রমে ক্রমে সমগ্র ভারতভূমিকে প্লাবিত করেছিল । পেত্রার্ক ও বোকাচ্চিও
যেমন ইটালির নবজাগরণের অগ্রদূত ছিলেন তেমনি পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত রাজা রামমোহন
রায় ছিলেন বাংলা তথা ভারতীয় নবজাগরণের অগ্রদূত । ১৭৭২ খ্রিস্টাব্দের ২২ শে মে (মতান্তরে
১৭৭৪ খ্রিস্টাব্দে ১৪ ই আগস্ট) হুগলী জেলার রাধানগর গ্রামে রাজা রামমোহন রায় জন্ম গ্রহণ
করেন । রাজা রামমোহন রায় পরিচালিত সংস্কার আন্দোলনে যুক্তিবাদী ও মানবতাবাদী চেতনার
প্রতিফলন পড়েছিল । প্রচলিত সামাজিক কুসংস্কার ও গোঁড়ামির অপসারণ করে তিনি সমাজ জীবনকে
কলুষ মুক্ত করতে চেয়ে ছিলেন ।
ধর্ম সংস্কার : রাজা রামমোহন রায়ের আবির্ভাবের সময় থেকে বাংলা তথা ভারতে নবজাগরণের সূত্রপাত হয় । বেদ, বাইবেল, কোরান, পুরাণ, উপনিষদ, গীতা, ভাগবত, জেন্দাবেস্তা, ত্রিপিটক ইত্যাদি সকল ধর্মশাস্ত্র গভীর মনোনিবেশ সহকারে অধ্যয়নের পর তিনি এই সত্যে উপনীত হয়েছিলেন যে সকল ধর্মই মূলত এক । একই ঈশ্বরে বিশ্বাস সকল ধর্মের মূল কথা । সামাজিক ও ধর্মীয় আচার আচরণ ও বাধা নিষেধের কোনো মূল্য নেই । রাজা রামমোহন রায় হিন্দুধর্মকে সংস্কারমুক্ত করার জন্য তিনি ১৮১৫ খ্রিস্টাব্দে প্রথমে 'আত্মীয় সভা' গঠন করেন । ১৮২৫ খ্রিস্টাব্দের আগস্ট মাসে তিনি একে 'ব্রাহ্মসভা'য় পরিণত করেন । ১৮২৮ এটি আবার 'ব্রাহ্মসমাজ' নামে পরিচিত হয় । ব্রাহ্মসভার মূল বক্তব্য ছিল, ঈশ্বর এক ও অভিন্ন, সকল ধর্মের মূল কথা এক । তিনি মনে করেছিলেন ব্রাহ্ম আন্দোলনের মাধ্যমে ভারতীয়গণের মধ্যে ধর্মগত ভেদাভেদ দূর হবে ।
শিক্ষা সংস্কার : স্বদেশ ও স্বদেশবাসীর প্রতি রাজা রামমোহন রায়ের প্রীতি ও শ্রদ্ধা ছিল সুগভীর এবং দেশবাসীর সামাজিক, ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক পুনরুজ্জীবনের জন্য তিনি সারা জীবন ধরে কঠোর পরিশ্রম করে গেছেন । ভারতীয় সমাজের দুরবস্থা ও সমকালীন দুর্নীতি তাঁকে ব্যথিত করেছিল । সে সময়ে সমাজে জাতপাতের বিচার ছিল প্রবল, ধর্ম ছিল কুসংস্কারে ভরা এবং ধর্মের নামে অশিক্ষিত ও দুর্নীতিপরায়ন পুরোহিত শ্রেণির আধিপত্য ছিল প্রবল । উচ্চশ্রেণির মানুষ ছিল স্বার্থপর । নিজেদের সংকীর্ণ স্বার্থসিদ্ধির জন্য সমাজের বৃহত্তর স্বার্থ জলাঞ্জলি দিতেও তাঁরা কুন্ঠিত হতেন না । প্রাচ্যের ঐতিহ্যময় দার্শনিক তত্ত্বের প্রতি রাজা রামমোহন রায়ের শ্রদ্ধা ছিল অগাধ, কিন্তু সেই সঙ্গে ভারতীয় সমাজের পুনরুজ্জীবনের জন্য পাশ্চাত্যের যুক্তিবাদ, বৈজ্ঞানিক মনোভাব ও মানবতাবাদের আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে সমাজের সকল শ্রেণির মানুষের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠাই ছিল রাজা রামমোহন রায়ের জীবনের সংকল্প । প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের শিক্ষা, সংস্কৃতি ও ধর্ম সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করার ফলে তাঁর চরিত্রে বহুত্বের এক বিরাট সমন্বয় ঘটেছিল বলে তাঁকে 'প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের এক পূর্ণ সমন্বয়ের প্রতীক' বলে অভিহিত করা হয়েছে ।
সমাজ সংস্কার : রাজা
রামমোহন রায় সমাজ সংস্কারের দিকেও মনোনিবেশ করেছিলেন । ভারতীয় নারীদের জন্য রাজা রামমোহন
রায়ের চিরস্মরণীয় অবদান হল সতীদাহ প্রথার অবসান ঘটানো ।
(১) সতীদাহ প্রথা :- রাজা রামমোহন রায়ের চিরস্মরণীয় পদক্ষেপ হল সতীদাহ প্রথার
অবসান ঘটানো । তত্কালে হিন্দু সমাজে মৃত স্বামীর জ্বলন্ত চিতায় বিধবাদের পুড়ে মরতে
হত । মৃত স্বামীর জ্বলন্ত চিতায় বিধবাদের সহমরণকে ‘সতীদাহ প্রথা’
বলা হত । প্রাচীনকাল থেকে এই প্রথার চল ছিল । এই নিষ্ঠুর প্রথা দূরীকরণের
জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করে ১৮১৮ খ্রিস্টাব্দ থেকেই রাজা রামমোহন রায় এই প্রথার বিরুদ্ধে
প্রবল জনমত গড়ে তুলতে প্রয়াসী হন । তিনি বিভিন্ন হিন্দুশাস্ত্র উদ্ধৃত করে এই মত প্রচার
করেন যে, সতীদাহ প্রথা ধর্মবিরুদ্ধ, সেই সঙ্গে তিনি জনমত গড়ে তোলেন । তাঁর প্রচেষ্টায়
বড়লাট লর্ড বেন্টিঙ্ক ১৮২৯ খ্রিস্টাব্দে ‘সপ্তদশ-বিধি’
নামে আইন পাস করে এই বর্বর 'সতীদাহ প্রথা' নিষিদ্ধ করেন ।
(২) বহু-বিবাহ ও বর্ণভেদ প্রথার বিরুদ্ধেও রাজা রামমোহন রায় তীব্র আন্দোলন
চালিয়ে যান ।
(৩) নারী ও পুরুষের সমানাধিকার ।
(৪) নারীরা যাতে স্বাধীনভাবে বাঁচতে পারে তার জন্য বিষয় সম্পত্তিতে নারীদের
উত্তরাধিকারের দাবি প্রতিষ্ঠিত করার ব্যাপারেও রামমোহন রায়ের চেষ্টার ত্রুটি ছিল না
। যদিও নারীশিক্ষা বিস্তারে তাঁর আগ্রহের অভাব কিছুটা বিস্ময়ের সৃষ্টি করে ।
(৫) রাজা রামমোহন রায় বিশ্বাস করতেন যে, পাশ্চাত্য শিক্ষার দ্বারাই ভারতীয়দের
উন্নতি সম্ভব হবে । তাই যাতে ভারতে রসায়ন শাস্ত্র, শারীরবিদ্যা, চিকিত্সাশাস্ত্র প্রভৃতি
শিক্ষার ব্যবস্থা করা হয় তার জন্য তিনি লর্ড আমহার্স্টকে পত্র লিখেছিলেন । কিন্তু তাঁর
দাবি উপেক্ষিত হয় । সরকার কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত হয়ে দূরদর্শী রাজা রামমোহন রায় , রাজা
রাধাকান্ত দেব, ভূকৈলাসের জয়নারায়াণ ঘোষাল ও মহাপ্রাণ ডেভিড হেয়ারের সহযোগিতায় ১৮১৭
খ্রিস্টাব্দে ২০ জানুয়ারী হিন্দু কলেজ স্থাপন করেন ।
রাজনৈতিক সংক্ষারঃ রাজনৈতিক
চেতনার উন্মেষের ক্ষেত্রে রামমোহনের অবদান অনস্বীকার্য। উচ্চহারে খাজনা আদায়, জমিদারদের
অত্যাচার প্রভৃতি সামাজিক উৎপীড়ন ও শোষণের বিরুদ্ধে তিনি রুখে দাঁড়ান এবং প্রতিবাদ
জানান। শাসন বিভাগ থেকে বিচার বিভাগ পৃথকীকরণ, জুরির সাহায্যে বিচার, উচ্চপদে ভারতীয়দের
নিয়োগ প্রভৃতি ক্ষেত্রে দাবি জানিয়ে ছিলেন তিনি। রামমোহনের রাজনৈতিক ভাবনা মন্টেস্কু , রুশো , ভলতেয়ার , টম - পেইন ,
বেনথাম প্রমুখের চিন্তাভাবনার দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল । তিনি মনে করতেন ভারতীয়দের
রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বিকাশ ঘটানোর জন্য ভারতবর্ষের শাসনভার কোম্পানির হাত থেকে নিয়ে
ব্রিটিশ পার্লামেন্টের হাতে তুলে দেওয়াই শ্রেয় ৷ রামমোহন সাংবিধানিক নিয়ম মেনে শান্তিপূর্ণ
পদ্ধতিতে শাসনতান্ত্রিক অধিকার অর্জনে বিশ্বাসী ছিলেন । সমকালীন ইউরোপের বিভিন্ন রাজনৈতিক ঘটনায় রামমোহনের
বিভিন্ন প্রতিক্রিয়া লক্ষ করা যায় ৷ যেমন ইতালির রাজতন্ত্র বিরোধী অভ্যুঙ্থানের
(১৮২) খ্রি. ) ব্যথর্তায় তিনি হতাশ হন, অন্যদিকে লাতিন আমেরিকায় স্পেন বিরোধী বিদ্বোহের
(১৮২৩ খ্রি. ) সফলতা এবং ফ্রান্সে ১৮৩০ খ্রিস্টাব্দের জুলাই বিপ্লবের সাফল্যে তিনি
উৎফুল্ল হন ।
মূল্যায়ন: ভারতীয়দের অন্ধবিশ্বাসের পরিবর্তে যুক্তিবাদ গ্রহণ,
স্বাধীনতা এবং মানবাত্মার মহত্ত্ব প্রতিষ্ঠায় রাজা রামমোহন রায় উল্লেখ যোগ্য অবদান
রেখে গেছেন । উনবিংশ শতাব্দীর বাংলা সমাজ, সংস্কৃতি এবং বাঙালির মনে রাজা রামমোহন রায়ের
সুস্পষ্ট প্রভাব বর্তমান । তাই তাঁকে বাংলা তথা ভারতের নবজাগরণের জনক বা আধুনিকতার
অগ্রপথিক রূপে বর্ণনা করা হয় । ১৮৩৩ খ্রিস্টাব্দে ২৭ শে সেপ্টেম্বর ইংল্যান্ডের ব্রিস্টল
শহরে রাজা রামমোহন রায়ের জীবনাবসান হয় ।