সমাজের একটি দৃষ্টান্ত মুলক ঘটনা : মেলা
সমাজের একটি দৃষ্টান্ত মুলক ঘটনা :
মেলা: মেলা
হল যখন একটি সামাজিক, ধর্মীয়, বাণিজ্যিক বা অন্যান্য কারণে একটি স্থানে অনেক মানুষ
একত্রিত হয়। মেলা শব্দটি শোনার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের মনে আনন্দের অনুভূতি হয়।মেলার
আক্ষরিক অর্থ মিলন। মেলায় একে অন্যের সঙ্গে ভাব বিনিময় হয়। মেলা সাধারণত কোনো বৃহৎ স্থানে,যেখানে মানুষের চলাচল
রয়েছে, তেমন স্থানে মেলা অনুষ্ঠিত হয়।মেলা অনেক ধরনের হয়। পহেলা বৈশাখ বাংলাদেশের
সবচেয়ে বড় মেলা। একে জাতীয় পর্যায়ের মেলাও বলা যায়। এই মেলায় বাংলার ঐতিহ্যের
ধারক-বাহক। মেলার সঙ্গে গ্রামীণ জনগোষ্টীর
কৃষ্টি ও সংস্কৃতির যোগাযোগ নিবিড় । বাংলার এই সংস্কৃতিতে থাকে সব ধর্মের মানুষের
সংস্কৃতির সমন্বয় । কয়েকটি গ্রামের মিলিত এলাকায় বা কোন খোলা মাঠে আয়োজন করা হয়
মেলার। মেলাকে ঘিরে গ্রামীণ জীবনে আসে প্রাণচাঞ্চল্য। গ্রামের মেলায় যাত্রা, পুতুল
নাচ, নাগরদোলা, জারি-সারি, রামায়ণ, গম্ভীরা কীর্তন, পালার আসর, ষাঁড়ের লড়াই, মোরগের
লড়াই, লাঠি খেলা, হাডুডু খেলা মুগ্ধ করে আগত দর্শনার্থীদের। এখনও নাগরদোলা সব বয়সীদের
কাছে প্রধান আকর্ষণ। মেলায় আবার বিভিন্ন নাটক বা যাত্রাপালারও আয়োজন করা হয়। গ্রামীণ মৃৎশিল্প ও কারুপণ্যের বিকিকিনি মেলার আরেক
আকর্ষণ। এসব মৃৎশিল্পের মধ্যে শখের হাঁড়ি, বিভিন্ন ধরনের মাটির পুতুল বেশ জনপ্রিয়।
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন,
‘প্রতিদিন মানুষ ক্ষুদ্র দীন একাকী। কিন্তু উৎসবের দিন মানুষ বৃহৎ, সেদিন সে সমস্ত মানুষের সঙ্গে একত্র হইয়া বৃহৎ, সেদিন সে সমস্ত মনুষ্যত্বের শক্তি অনুভব করিয়া মহৎ’
কবিগুরু যথার্থই বলেছেন। উপলক্ষ যাই হোক না কেন, বাঙালির সকল উৎসবের মধ্যে
একটা সার্বজনীন রূপ আছে। এতে ধর্ম, সম্প্রদায়, জাত-পাত বা ধনী-গরিবের সামাজিক বিভক্তি
বাধা হয়ে দাঁড়ায় না বরং সকল শ্রেণির মধ্যে সেতুবন্ধন রচিত হয়। আর এ কারণেই কালের
বিবর্তনের সঙ্গে আনুষ্ঠানিকতার ধরন পাল্টালেও আবহমান বাংলার সামাজিক উৎসব, পার্বণ বা
গণমানুষের মেলবন্ধনের ঐতিহ্য-কৃষ্টিগুলো আজও হারিয়ে যায়নি। মেলা মানেই মহামিলন। মানুষের
উচ্ছ্বাস-উল্লাসের বহিঃপ্রকাশ ঘটে মেলার মধ্য দিয়ে। ধর্ম-বর্ণ-সম্প্রদায়ের উর্ধে
উঠে মেলা মানুষের মধ্যে সম্প্রীতির বন্ধন গড়ে দেয়। গ্রাম-বাংলার মেলা তাই হাজার বছরের
ঐতিহ্যের এক মহা সম্মিলন। কবে, কোথায়, কখন
প্রথম মেলার প্রচলন হয়েছিল তা জানা না গেলেও এটি যে আবহমান বাংলার এক প্রাচীণ ঐতিহ্য
এ বিষয়ে সন্দেহ নেই। ধারণা করা হয়, গ্রামীণ হাট থেকেই আসে মেলার ধারণা। অতীতে রাজা-জমিদারেরা
মেলার আয়োজন বা পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। ধর্মীয় কোনো উপলক্ষে মেলা বসত। তাই বাংলার বারো
মাসের তেরো পার্বণের সঙ্গেই জড়িয়ে আছে মেলা। বৈশাখ থেকে চৈত্র প্রতি মাসেই মেলা অনুষ্ঠিত
হতে দেখা যায়। এক সময় পীর-ফকির বা সাধু-সন্ন্যাসীদের আস্তানাগুলোও মেলার কেন্দ্রবিন্দুতে
পরিণত হয়। ধর্মীয় চেতনার বাইরে অন্যান্য সামাজিক বা লৌকিক আচারগুলোও যুক্ত হতে থাকে
মেলার সঙ্গে।
মেলার উপকরণ সমূহ : মেলা সামনে রেখে চারু, কারু ও অন্যান্য
কুটির শিল্পীরা দীর্ঘ সময় নিয়ে প্রস্তুতি নেয়। কামার, কুমার, ও বাঁশ-বেতের শিল্পীরা
নিপুণ হাতে তৈরি করে বিভিন্ন সামগ্রী। শিশু থেকে বৃদ্ধ সব বয়সের মানুষের আকর্ষণ থাকে
মেলায়। গ্রাম-বাংলার অনেকে মেলা থেকেই পুরো বছরের ঘর গেরস্থালির তৈজসপত্র কিনে থাকেন।
ফলে মেলা উপলক্ষে গ্রাহকদেরও প্রস্তুতি থাকে। অভাব-অনটন যতই থাকুক, মেলার জন্য সকলেরই
ছোটখাটো বাজেট থাকে। মেলার আগে বড়রা শিশুদের নগদ টাকা বকশিশ দেন। অঞ্চল বিশেষে এ ধরনের
উপহারকে বলা হয় ‘মেলার পড়বি ।বাহারি পণ্যের পসরা বসে মেলায়। শিশুদের আনন্দ-বিনোদনের
জন্য মেলায় পাওয়া যায় মাটির পুতুল, পালকি, ঘোড়া, ষাঁড়, হরিণ, হরেক রকমের ঘুড়ি,
টমটম, লাটিম, গাড়ি, বল, বেলুন, বাঁশিসহ নানান রকমের খেলনা। গাঁয়ের বধূ ও কিশোরীরা
মেলা থেকে কিনে নেন আলতা, স্নো, পাউডার, কাঁচের চুড়ি, নাকের নোলক, কানের দুল, চুলের
ফিতা, খোপা, ক্লিপসহ দেহাবরণের জিনিসপত্র। হিন্দু রমণীরা মেলা থেকে ফিরে একে অপরকে
জলেভাসা সাবান ও সিঁদুর উপহার দিয়ে শুভ কামনা জানান। এ ছাড়া গেরস্থালির জিনিসপত্র
যেমন দা, কাঁচি, কুড়াল, খুন্তি, রান্না-বান্নার সরঞ্জাম, পাখা, চালনি, জলচৌকি, পিঁড়ি
থেকে শুরু করে বৃদ্ধদের ছড়িও পাওয়া যায় মেলায়। থাকে রসনা তৃপ্তির জিনিসপত্রও। বিশেষ
করে মেলা থেকে কেনা জিলাপি, গজা, রসগোল্লা, কদমা, বাতাসা, বিন্নি ধানের খৈ ও দই-চিড়ার
স্বাদই যেন আলাদা। কাপড়, মনোহারি, প্লাস্টিক পণ্য, পূজার জিনিসপত্র, ধর্মীয় পোস্টার,
ছবি, বাঁশ-বেতের সামগ্রী, তামা-কাঁসা-পিতলের বাসনপত্র প্রভৃতির দোকানও বসে মেলায়।
মেলার বিনোদনের উৎস সমূহঃ মেলায়
দর্শকদের তাৎক্ষণিক মনোরঞ্জনের জন্যও থাকে নানান আয়োজন। নাগরদোলা, লাঠি খেলা, কুস্তিখেলা,
পুতুল নাচ, যাত্রাগান, কবিগান, বাউল গান, ঘেটু গান, জারি গান, গাজীর গান, পীর-ফকিরদের
গান, বায়স্কোপ, সং, সার্কাস, লটারি, কীর্ত্তন, নৌকা বাইচ, ষাঁড়ের লড়াই প্রভৃতি আয়োজন
দর্শকদের বাড়তি আনন্দের খোরাক যোগায়। অষ্টমী, বারুনী বা বিভিন্ন পূণ্যস্থানের মেলাকে
বাংলার মানুষ ধর্মীয় উৎসব বলেই মনে করে। মূলত এসব লোকজ মেলাকে লক্ষ্য করেই দেশীয়
সার্কাস ও যাত্রা শিল্পী গোষ্ঠীর বিকাশ ঘটেছে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য মেলার নামে অনেক জায়গায়
জুয়া-হাউজি-অশ্লীল নৃত্যসহ কিছু অপ-সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড হয়। এগুলো মেলার মূল সংস্কৃতি
নয়। মূলত এর পেছনে থাকে অর্থলিপ্সা। মেলায় হাজারো মানুষের স্রোত পূঁজি করে এক শ্রেণির
লোক এ ধরনের বেআইনি উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার চেষ্টা করে। এতে মেলার পরিবেশ শ্রীহীন হয়।
তবে সর্বসাধারণ কখনও এ বিষয়গুলোকে মেলার আঙ্গিক হিসাবে মনে করেন না। তারা মেলাকে ধর্মীয়
উৎসব, লোকাচার, আনন্দ-বিনোদন বা বছরের কোনো একটি বিশেষ দিন হিসেবেই বিবেচনা করে।