বিধবা বিবাহ আন্দোলনে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের অবদান আলোচনা করো
ভূমিকাঃ- “বিধবা
বিবাহ” স্রেফ দুটি শব্দ। এই দুটি শব্দই কাঁপিয়ে দিয়েছিল তৎকালীন সমাজকে। কেউ কেউ তো
বলেই বসেছিলেন যে সমাজ নাকি রসাতলে গেলো! হিন্দু ধর্ম উচ্ছন্নে গেলো! কত বিতর্ক, কত
বিদ্রুপ। কেউ পক্ষে তো কেউ বিপক্ষে। কেউ আবার নির্লিপ্ত। কিন্তু তখনকার সমাজে বিধবা
হওয়া মাত্র যাদের জীবনে নেমে আসতো বন্দিদশার অভিশাপ, ধর্মের করাল কুঠার; তাঁরা পেয়েছিলেন
এক ঝলক টাটকা বাতাস, মুক্তির স্বাদ, নতুন করে বাঁচার আশ্বাস, ‘পাপ’ নামক বস্তুটি থেকে
মুক্তি। বাংলা সাহিত্যের প্রসার, সংস্কৃত সাহিত্যের
সহজসরল অনুবাদ নারী শিক্ষা বিস্তারে বহু প্রবন্ধ লিখে সমাজে আলোড়ন তুলেছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র
বিদ্যাসাগর। নারীর সম্মান ও আত্মমর্যাদা রক্ষার্থে সর্বদা সচেষ্ট ছিলেন তিনি। সমাজে
বিধবা বিবাহ প্রচলন করে বিদ্যাসাগর বিশেষভাবে স্মরণীয় হয়ে আছেন।
এই বিধবা বিবাহ প্রচলন নিয়ে একটি ঘটনার উল্লেখ করা প্রয়োজন। ছোটবেলায় রাইমণি
নামে খেলার এক সঙ্গিনী ছিল বিদ্যাসাগরের। রাইমণিকে ভালোবাসতেন তিনি। রাইমণির খুব অল্প
বয়সে বিয়ে হয়ে যায়। কিছু বছর পরে বিধবা হয়ে একমাত্র সন্তান গোপালকে নিয়ে নিজের গ্রাম
বীরসিংহে ফিরে আসে রাইমণি। বিদ্যাসাগরও গ্রামে ফিরে একদিন খোঁজ নিতে গিয়ে দেখেন রাইমণি
শুকনো মুখে দাঁড়িয়ে আছে। সেদিন ছিল একাদশী। সারাদিন রাইমণির উপবাসের করুণ চিহ্ন প্রত্যক্ষ
করে বিদ্যাসাগরের মনে একদিকে যেমন বৃষ্টির মতো কান্না ঝরছিল তেমনি অন্যদিকে আগুনও জ্বলছিল।
তিনি অনুভব করেছিলেন হিন্দু বাল্য বিধবাদের বৈধব্য যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দিতে হলে প্রয়োজন
তাঁদের পুনর্বিবাহ।
আন্দোলনের সূত্রপাতঃ- বিধবাদের
এই যন্ত্রণার নিরসনে,বিধবাবিবাহ প্রচলনে বহু সমাজ সংস্কার আন্দোলন গড়ে ওঠে। তবে ২
রক্ষণশীল, গোঁড়া হিন্দুদের চাপে এগুলি সফল হয়নি।উনিশ শতকের মধ্যভাগে তত্ত্ববোধিনী
সভা’, ‘নব্যবঙ্গ গোষ্ঠী’,সুহৃদ
সভা’, ‘ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন’, ‘সত্যশোধক
সমাজ, প্রার্থনা সমাজ’ প্রভৃতি
বিধবাবিবাহের প্রচলনে গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ গ্রহণ ২ করে। সমাচার দর্পণ’, ‘জ্ঞানান্বেষণ'
প্রভৃতি পত্রিকাতেও এর পক্ষে প্রচার চালানো
হয়।
বিদ্যাসাগরের ভুমিকাঃ – বিধবাবিবাহের পক্ষে সবচেয়ে জোরালো আন্দোলন গড়ে
তোলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। বিধবাদের যন্ত্রণা, করুণদশাতকে সর্বাধিক ব্যথিত করে
তোলে। তিনি বিধবাবিবাহের প্রচলনের জন্য বিভিন্ন ভাবে জনমত গঠনে প্রচেষ্টা চালান
বিধবাদের অবস্থাঃ-ভারতে হিন্দু সমাজে যে সমস্ত কুপ্রথাগুলি প্রচলিত ছিল
বাল্যবিবাহ তার মধ্যে অন্যতম। এরই অবশ্যম্ভাবী ফল হল বাল্যবিধবা। প্রাচীন কালে বিধবা
বিবাহের প্রচলন থাকলেও পরবর্তীকালে ধর্মীয় ও সামাজিক বিধিবিধানে বিধবাবিবাহ নিষিদ্ধ
হয়।
গ্রন্থ প্রকাশের মাধ্যমে জনমত গঠনঃ- তিনি ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দে বিধবাবিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিত কিনা এতদবিষয়ক প্রস্তাব’
নামে একটি পুস্তিকা রচনা করেন। এতে ‘পরাশর সংহিতা’র উদ্ধৃতি
থেকে তিনি প্রমাণ করেন বিধবা বিবাহ শাস্ত্রসম্মত।
সংবাদপত্রের মাধ্যমে জনমত গঠনঃ- ১৮৫০ খ্রিস্টাব্দে সর্বশুভকরী’
পত্রিকায় তিনি বাল্যবিবাহের দোষ’
নামক একটি নিবন্ধ লেখেন। ১৮৫৪ খ্রিস্টাব্দে তত্ত্ববোধিনী পত্রিকায় বিধবা
বিবাহের সমর্থনে একটি প্রবন্ধ লেখেন। এগুলিতে বিধবাদের করুণ দুর্দশার কথা তুলে ধরেন।
সরকারের কাছে আবেদনঃ- ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দে ৯৮৭জন বিশিষ্ট ব্যক্তির স্বাক্ষরযুক্ত
বিধবাবিবাহের পক্ষে লেখা একটি আবেদনপত্র সরকারের কাছে পাঠান।এর প্রতিবাদে রক্ষণশীল
হিন্দু সমাজের নেতা রাধাকান্ত দেবের নেতৃত্বে ৩৬৭৬৩জনের স্বাক্ষর সম্বলিত আবেদন সরকারের
কাছে পাঠানো হয়।
বিধবাবিবাহ আইন পাসঃ- বিদ্যাসাগরের জোরালো দাবির ভিত্তিতে সরকার ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দের
২৬ জুলাই ১৫নং রেগুলেশন দ্বারা বিধবাবিবাহ আইনসিদ্ধ ঘোষণা করেন।
উপসংহারঃ- পরিশেষে বলা যায় যে, ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দের ৭ ডিসেম্বর সংস্কৃত কলেজের অধ্যাপক
শ্রীশচন্দ্র বিদ্যারত্নের সঙ্গে কালীমতি দেবীর প্রথম বিধবা বিবাহ অনুষ্ঠিত হয়। তিনি
নিজপুত্র নারায়ণচন্দ্রের সঙ্গে বিধবা ভবসুন্দরী দেবীর বিবাহ দেন। বিধবাদের জন্য তিনি
১৮৭২ খ্রিস্টাব্দে গড়ে তোলেন হিন্দু ফ্যামিলি অ্যানুইটি ফান্ড'।