প্রাচীন ভারতের ইতিহাস রচনায় প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদানের ভূমিকা উল্লেখ করো ।
প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদান : প্রাচীন লিপি, মুদ্রা, স্থাপত্য-ভাস্কর্য -এর নিদর্শন ও ঐতিহাসিক ধ্বংসাবশেষ প্রভৃতি হল ইতিহাসের প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদান। প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদানের নির্ভরযােগ্যতা অনেক বেশি, কারণ এখানে ভূল তথ্য পরিবেশনের সুযােগ প্রায় নেই।
প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদানগুলিকে মূলত তিন ভাগে ভাগ করা যায় :
(i) লিপি
(ii) মুদ্রা ও
(iii) স্থাপত্য ও ভাস্কর্য বা প্রাচীন ধ্বংসাবশেষ :
1. লিপি - পাথর, তামা, লােহা, ব্রোঞ্জ ও পােড়ামাটির উপর খােদাই করা লিপি থেকে তৎকালীন . রাজনৈতিক, আর্থসামাজিক এবং ধর্মীয় জীবনযাত্রার পরিচয় পাওয়া যায় । সে জন্য লিপিকে ইতিহাসের জীবন্ত দলিল বলে অভিহিত করা হয়। সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে সাহিত্যের ভাষা ও বক্তব্যের পরিবর্তন ঘটলেও লিপি সবসময় অপরিবর্তিত থাকে বা তথ্য বিকৃত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে না ।
লিপিকেও আবার দুই ভাগে ভাগ করা যায় এই গুলি হল ----
ক) দেশীয় লিপি- ব্রাহ্মী, খরােষ্ঠী, তামিল, পালি, সংস্কৃত, প্রাকৃত প্রভৃতি বহু ভাষায় লেখা প্রাচীন ভারতীয় লিপিগুলির প্রধান বিষয়বস্তু ছিল ভারতীয় রাজাদের রাজ্যজয়, রাজপ্রশস্তি, ভূমিদান, শাসন, ধর্ম, রাজনৈতিক ঘটনা, ব্যবসাবাণিজ্য প্রভৃতি । প্রাচীন ভারতের লিপি গুলির মধ্যে অশােকের শিলালিপি সবচেয়ে উল্লেখযােগ্য । এছাড়া হরিসেন বিরচিত 'এলাহাবাদ প্রশস্তি থেকে সমুদ্রগুপ্তের বিজয় কাহিনী জানা যায় । কলিঙ্গরাজ খারবেলের হস্তিগুম্ফা লিপি' প্রতিহাররাজ ভােজের ‘গােয়ালিয়র প্রশস্তি' বিজয় সেনের ‘দেওপাড়া লিপি' চালুক্যরাজ দ্বিতীয় পুলকেশীর ‘আইহােল লিপি’ শকক্ষত্ৰপ রুদ্রমনের 'জুনাগড় লিপি' বিশেষ উল্লেখযােগ্য । হরপ্পা ও মহেঞ্জোদারােয় প্রাপ্ত লিপির পাঠোদ্ধার আজও হয়নি। দাক্ষিনাত্যের পল্লব, চোল, চালুক্য, রাষ্ট্রকূট, বাকাটক প্রভৃতি রাজবংশের ইতিহাসের জন্য লিপির উপর নির্ভরশীল হতে হয় । ঐতিহাসিক ভিনসেন্ট স্মিথ, ড: রমেশচন্দ্র মজুমদার, প্রমুখ ঐতিহাসিক উপাদান হিসাবে লিপিকে প্রথম স্থানে রেখেছেন। T
খ) বিদেশী লিপি :এশিয়া মাইনর, কম্বােডিয়া, চম্পা, যবদ্বীপ, গ্রিস ও পারস্য প্রভৃতি বৈদেশিক অঞ্চলগুলি থেকে পাওয়া লিপিগুলি থেকে এইসব অঞ্চলের সঙ্গে প্রাচীন ভারতের সাংস্কৃতিক ও বাণিজ্যিক সম্পর্কের ইতিহাস পাওয়া যায় ।
2. মুদ্ৰা : রাজার নাম ও সাল-তারিখ মুদ্রা থেকে জানা যায়। ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ও ধাতুবিদ্যার উৎকর্ষতা মুদ্রা মারফত জানতে পারা যায় । মুদ্রায় অঙ্কিত চিত্রের মাধ্যমে সেই রাজার গুণাবলী সম্পর্কে স্পষ্ট ধারনা করা যায় । যেমন সমুদ্র গুপ্তের মুদ্রায় বীণাবাদনরত মূর্তি থেকে তাঁর সঙ্গীতানুরাগের পরিচয় পাওয়া যায়। ব্যাকট্রীয়, গ্রিক, শক, কুষান রাজাদের কাহিনী মুদ্রা থেকেই জানতে পারা যায় । সাতবাহন সাম্রাজ্যের ইতিহাসের অন্যতম প্রধান উপাদান হল মুদ্রা । গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতনের পর থেকে ঐতিহাসিক উপাদান হিসাবে মুদ্রার গুরুত্ব কিছুটা হ্রাস পেয়েছে।
3. স্থাপত্য ও ভাস্কর্য বা প্রাচীন ধ্বংসাবশেষ: প্রাচীন নগরের ধ্বংসাবশেষ, স্মৃতিসৌধ, মন্দির, স্থাপত্য, ভাস্কর্য ইত্যাদি ইতিহাসের নীরব সাক্ষী। হরপ্পা, মহেনজোদাের ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কৃত না হলে ভারত ইতিহাসের এক অমূল্য অধ্যায় আমাদের কাছে অজ্ঞাত থেকে যেত। সাঁচি, নালন্দা, অজন্তা, ইলােরা, তক্ষশীলা ইত্যাদি অনেক অজানা তথ্যের সন্ধান দেয়। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় প্রাপ্ত ধ্বংসাবশেষ থেকে ভারতবর্ষের বাইরে উপনিবেশ ও সংস্কৃতি বিস্তারের কথা জানতে পারা যায় ।