দশম শ্রেণীর বাংলা অসুখী একজন কবিতার প্রশ্নোত্তর পর্ব



● অতিসংক্ষিপ্ত উত্তরভিত্তিক প্রশ্নাবলি (প্রশ্নমান-১)
১) পাবলাে নেরুদার আসল নাম কী? 
উঃ পাবলাে নেরুদার আসল নাম নেকতালি রিকার্দো রেয়েন্স বাসােয়ালতাে। (সম্ভবত চেক লেখক জাঁ নেরুদা ও পাবলাে পিকাসাে খ্যাতি সাযুজ্য ঘটিয়ে পাবলাে নেরুদা নামটি গঠিত হয়েছে।
২) আর সেই মেয়েটি আমার অপেক্ষায়। -কে, কার অপেক্ষায় রয়েছে? 
উঃ দেশমাতৃকা দেশপ্রেমিক/কথকের ফেরার অপেক্ষায় রয়েছে। 
৩) আমি চলে যাওয়ার পর আর কী কী চলে গেল? 
উঃ আমি অর্থাৎ কথক চলে যাওয়ার পর একটা কুকুর, একজন খ্রিস্টান সন্ন্যাসিনী, একটা সপ্তাহ এবং একটা বছর চলে গেল।
৪) আমি চলে যাওয়ার পর বাড়ির সামনে কী কী পরিবর্তন হল ? 
উঃ আমি অর্থাৎ কথক চলে যাওয়ার পর বৃষ্টিতে পায়ের দাগ ধুয়ে গেল এবং বাড়ির সামনে রাস্তায় ঘাস জন্মালাে।
৫) ‘সেই মেয়েটির মৃত্যু হল না। কেন?  
উঃ মেয়েটি শরীরী নারীমূর্তী নয়। মেয়েটি আসলে কথকের জন্মভূমি মা, প্রেম ও মানবতার প্রতীক। তাই যুদ্ধে দেশীয় সভ্যতার মৃত্যু হলেও দেশমাতৃকা ও মানবতার মৃত্যু হয়নি। 
৬) মন্দিরে দেবতারা কী করছিল?
উঃ জীবকে জিইয়ে রাখার দায়িত্ব দেবতার। যুদ্ধ আর শবের মিছিল রােধে দেবতাদের কোনাে ভূমিকা না দেখতে পেয়েই কবি ক্ষোভ উগরে দিয়ে উচ্চারণ করেছেন—“শান্ত হলুদ দেবতারা / যারা হাজার বছর ধরে / ডুবে ছিল ধ্যানে।
৭) রক্তের একটা কালাে দাগ’-কেন এই কালাে দাগ ?
উঃ যুদ্ধে বহু মানুষ আহত-নিহত হন। যুদ্ধ শেষে সব শান্ত হয়ে গেলেও শুকানাে রক্তের দাগ কালাে চিহ্ন রেখে যায়। যুদ্ধের স্মৃতি কবি মনে হত্যালীলার একটা কালাে ছাপ—(Black Spot) রেখে গিয়েছে।
৮) যুদ্ধের পর শহরের চেহারা কেমন হয়েছিল ?
উঃ যুদ্ধের পর শহর আর শহর হয়ে নেই, সেখানে ছড়িয়ে ছিল শুধু কাঠকয়লা আর দোমড়ানাে লােহা, পাথরের মূর্তির ভগ্নাবশেষ আর রক্তের একটা কালাে দাগ। 
৯) ‘অসুখী একজন’ কে?
উঃ ‘অসুখী’ স্বয়ং কবি। কেননা যে দেশে তার জন্ম, যেখানে কেটেছে শৈশব, সেই জায়গা তাকে ত্যাগ করতে হয়েছে। সেখানের রাজনৈতিক অস্থিরতা, সামরিক অভ্যুত্থান, যুদ্ধ, ধ্বংস সবকিছু দেখে বিষাদগ্রস্ত মন থেকেই মনে হয় এই কবিতার জন্ম। আর সেই মেয়েটি আমার অপেক্ষায়’ সে জানে না আমি আর ফিরব না, সে জানে না আমি আর নেই, তার অসুখী হওয়ার কারণ এখনও ঘটেনি তাই তাকে এখনই অসুখী বলা যাবে না।

● সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যাধর্মী উত্তরভিত্তিক প্রশ্নাবলি (প্রশ্নমান-৩)
১) ‘আমি তাকে ছেড়ে দিলাম’—আমি কে, কাকে এবং কীভাবে ছেড়ে দিলে? 
উঃ পাবলাে নেরুদার ‘অসুখী একজন’ কবিতায় আমি বলতে কবিতার কথককে বােঝানাে হয়েছে।
কথক তার প্রিয় নারী বা মাতৃভূমিকে ছেড়ে অনেক দূরে চলে গেলেন। কোনাে অজ্ঞাত কারণে কথককে ছেড়ে যেতে হয়েছে তার প্রিয় মাতৃভূমি। অপেক্ষারত নারী, প্রেমিকা বা দেশমাতৃকা জানে না যে এই যাওয়াই হয়তাে কথকের শেষ যাওয়া। প্রেমিকা বা দেশমাতৃকার মনে ফিরে আসার আশা জাগিয়ে অপেক্ষায় রেখে তিনি চিরবিদায় নিয়েছেন। 
২) ‘বৃষ্টিতে ধুয়ে দিল আমার পায়ের দাগ/ঘাস জন্মালাে রাস্তায়’—উদ্ধৃতাংশের তাৎপর্য লেখাে।
উঃ) পাবলাে নেরুদার ‘অসুখী একজন’ কবিতায় কথক বা প্রেমিক বা দেশপ্রেমিক তার প্রিয়তমা বা জন্মভূমি মাকে অপেক্ষায় রেখে দূরে-বহুদূরে চলে যান। থমকে যায় মেয়েটির জীবন। কিন্তু সময় থেমে থাকে না, তাই কথকের চলে যাওয়াতে স্বাভাবিক জীবন ব্যাহত য়নি। সপ্তাহ, বছর কেটে যায়, প্রাকৃতিক নিয়মেই কথকের হাঁটা-চলার পথে ঘাস জন্মে কথকের পায়ের ছাপ মুছে দিল। অর্থাৎ তিনি প্রিয়জনের মনে স্মৃতি হয়ে থাকেন। 
৩) ‘একটা কুকুর চলে গেল’— কথাটির তাৎপর্য কী?
উঃ) পাবলাে নেরুদার ‘অসুখী একজন’ কবিতায় কথক কর্মসূত্রে বাইরে যাওয়ার জন্য বিদায় নিচ্ছেন। তার এই বিদায়ের মধ্যে ক্ষীণ হলেও একটা ফিরে আসার সম্ভাবনা থাকে। প্রতীকী হিসেবে একটা কুকুরের বিকারহীন চলে যাওয়ার দৃশ্য মনে হতাশা এনে দেয়, কথকের ফিরে না আসার সম্ভাবনাকে শতগুণে বাড়িয়ে দেয়। তা ছাড়া সমাজ ও সময় কারাে জন্য অপেক্ষা করে না, ক্ষণিকের স্তব্ধতা মিলিয়ে যায় স্বাভাবিকতার মাঝে। 
৪) ‘শিশু আর বাড়িরা খুন হল।’- শিশু আর বাড়িরা কেন খুন হল? ‘শিশু’ আর ‘বাড়িরা বলতে কী বােঝানাে হয়েছে?
উঃ পাবলাে নেরুদার ‘অসুখী একজন’ কবিতায় ‘শিশু’ ও ‘বাড়ি’-দের খুন হওয়ার প্রসঙ্গ টেনে কবি ফুটিয়ে তুলেছেন যুদ্ধের ভয়াবহতা ও বিষাদের রূপ। যুদ্ধ মানেই হত্যা, ধ্বংসলীলা। কবিতায় কবি ‘শিশু’ বলতে পরবর্তী প্রজন্মকে এবং বাড়িরা’ বলতে নিশ্চিন্ত নিরাপদ শান্তিপূর্ণ আশ্রয়কে বুঝিয়েছেন। মনুষ্যত্বহীন হামলাবাজের ধ্বংসলীলা কোনাে কিছুকেই নিস্তার দেয় না। তাই যুদ্ধের নির্বিচার গােলাবারুদে হাজার হাজার নিস্পাপ শিশুর যেমন মৃত্যু হয়েছে, তেমনি ধ্বংস হয়েছে সুন্দর নিরাপদ শান্তিপূর্ণ বাড়িগুলাে।

● রচনাধর্মী উত্তরভিত্তিক প্রশ্নাবলি (প্রশ্নমান-৫) 
১) অসুখী একজন’ কবিতার মর্মার্থ বিশ্লেষণ করে কে, কেন অসুখী বুঝিয়ে দাও। 
উঃ) পাবলাে নেরুদার ‘অসুখী একজন’কবিতায় কবি মানবতার জয়গান গেয়েছেন। কবিতার কথক তার নারীরূপী মাতৃভূমিকে ছেড়ে দূরে চলে যেতে বাধ্য হয়েছেন। তিনি তাঁর প্রিয় নারীকে দরজায় দাঁড় করিয়ে রেখে চলে গেছেন। তাঁর প্রিয়তমা প্রতীক্ষমানা। কেননা সে জানে না যে কথক আর কখনও ফিরে আসবে না। তাই সে তার ফেরার অপেক্ষায় পথ চেয়ে থেকেছে বছরের পর বছর। অপেক্ষা রতার কাছে বছরগুলাে পাথরের মতাে ভারী। মেয়েটির অপেক্ষা যেন ঐ ভারী পাথরের মতােই মাথার উপর নেমে আসে। পথ চেয়ে দাঁড়িয়ে থাকা প্রেমিকার অন্তর বিরহ বেদনায় ভারাক্রান্ত। 
◆ এর পর শুরু হল যুদ্ধ। যুদ্ধের ধ্বংসলীলায় শহর-নগর সব তছনছ হয়ে গেল। মনুষত্বহীন হামলাবাজদের হাত থেকে নিস্তার পেল না নিস্পাপ শিশুরা এবং সুন্দর নিরাপদ শান্তিপূর্ণ বাড়িগুলােও। ভগ্ন মন্দির থেকে ছিটকে গেল দেবতারা। কিন্তু এই যুদ্ধে বা ধ্বংসলীলায় সেই মেয়েটির মৃত্যু হল না। লয়হীন, ক্ষয়হীন কবির এই মানস প্রতিমা অর্থাৎ অপেক্ষমানা মেয়েটিততা আসলে জীবনের, মানবতার বিমূর্ত রূপ তাই তার মৃত্যু হল না।
◆ কবিতায় অসুখী সেই নারীরুপী জন্মভূমি, যে প্রেম ও মানবতার প্রতীক। দীর্ঘ অপেক্ষায় ক্লান্ত প্রেমিকা প্রিয়জনের বিচ্ছেদে অসুখী, আবার যুদ্ধের বীভৎসতা দেখে সে আরও অসুখী। অপরদিকে কবিতার কথকও অসুখী। তিনি প্রিয়তমা, প্রিয় জন্মভূমি, তার সুখস্মৃতি, পরিজন সব ছেড়ে দূরে বহুদূরে চলে গিয়েছেন। আর ফিরে আসতে পারেননি তাঁর প্রিয় জন্মভূমিতে। যুদ্ধে ধ্বংস হয়ে যায় তার মিষ্টি বাড়ি, ঝুলন্ত বিছানা, গােলাপি গাছ, চিমনি, জলতরঙ্গ। সুতরাং তার বিরহ-বেদনা নিতান্ত কম নয়। এই যুদ্ধ, ধ্বংস প্রিয়হারার বেদনায় কথকও অসুখী।
২) ‘তারপর যুদ্ধ এল।'—সেই যুদ্ধের বিভীষিকার যে চিত্র অঙ্কিত হয়েছে তা নিজের ভাষায় লেখাে।
উঃ পাবলাে নেরুদার ‘অসুখী একজন’ কবিতায় যুদ্ধের বীভৎসতার পরিচয় আছে। তারপর যুদ্ধ এল’ বলে কবি তার বীভৎসতা দেখিয়েছেন। আগ্নেয় পাহাড় যেমন ঝলকে  আগুন আর লাভা উদগিরণ করে—এক্ষেত্রে মানুষের রক্তস্রোত সেই জায়গা নিল। শিশু, বাড়িঘরদোর সব ধ্বংস হয়ে গেল। পৃথিবীকে গ্রাস করল সর্বাত্মক ধ্বংসের আগুন। কবির ঘর, দোলনা, চিমনি, মিষ্টি বাড়ির সবটা ধ্বংস হয়ে গেল। শান্ত, প্রাচীন (জীর্ণতায় হলুদ হয়ে যাওয়া) দেবতারা মন্দির থেকে ভেঙে টুকরাে টুকরাে হয়ে পড়ল পথেঘাটে—স্বপ্ন শেষ হয়ে গেল, ধ্যান গেল ছুটে। শহর জ্বলে গিয়ে পড়ে রইল ধ্বংসস্তুপ, কাঠকয়লা, দোমড়ানাে মােচড়ানাে লােহা, আর পাথরের মূর্তিগুলাের বীভৎস মাথা। গােলাপি গাছ, প্রাচীন জলতরঙ্গ হাতের তালুর মতাে পড়ে রইল চিমনি, অর্থাৎ সব শেষ। চারদিকে শুকিয়ে যাওয়া রক্তের কালাে দাগ এই যুদ্ধের বিভীষিকার ভয়াবহ স্মৃতি।
Write Your HideComments
Cancel

Please Do Not Enter Any Span Link in The Comment Box