বড়ু চণ্ডীদাসের ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন' কাব্য সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলােচনা করাে।

■ শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্য : বড়ু চণ্ডীদাসের ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’ রাধাকৃয়ের প্রণয়লীলাকে অবলম্বন করে লেখা একটি আখ্যান কাব্য, যার বিন্যাসে আছে নাটকীয়তা, অন্তরে গীতিকাব্যের ধর্ম। এটি অনেকটা জয়দেবের গীতগােবিন্দের অনুকরণে রচিত গীতিনাট্য-শ্রেণির রচনা। সুকুমার সেন বলেছেন, “শ্রীকৃষ্ণকীর্তন' নাট্যগীতিকাব্যধারা অর্থাৎ কতকগুলি ছােট ছােট নাট্যগীতির মালা। কাব্যটির তেরােটি খণ্ড হল: (১) জন্ম খণ্ড, (২) তাম্বুল খণ্ড, (৩) দান খণ্ড, (৪) নৌকা খণ্ড, (৫) ভার খণ্ড, (৬) ছত্র খণ্ড, (৭) বৃন্দাবন খণ্ড, (৮) কালীয়দমন খণ্ড, (৯) যমুনা খণ্ড, (১০) হার খন্ড, (১১) বাণ খণ্ড, (১২) বংশী খণ্ড এবং (১৩) রাধাবিরহ। শেষ খণ্ডটির নামে ‘খণ্ড’ শব্দের উল্লেখ না থাকায় অনেকে এটিকে প্রক্ষিপ্ত বলে মনে করেন। কৃয়ের জন্ম থেকে মথুরা প্রবাস পর্যন্ত কাহিনি বিন্যস্ত হয়েছে এই খণ্ডগুলিতে। মানুষের হিত সাধন ও কংস নিধনের জন্য বিয়ু ও লক্ষ্মীদেবীর যথাক্রমে কৃয় ও রাধারূপে মর্তে আবির্ভাব। মর্তে রাধার বিবাহ হয় আয়ান ঘােষের সঙ্গে। কৃয় সম্পর্কে প্রথমে রাধার বিরূপতা থাকলেও বড়াইয়ের মধ্যস্থতায় তা দূর হয়। কংসবধের জন্য কৃয় মথুরা গমন করলে রাধা তাঁর বিরহে কাতর হয়ে পড়েন। কৃয়কে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য বড়াই মথুরায় গেলে কৃয় তাকে বলেন যে তিনি কংসবধের জন্য গােকুল ত্যাগ করে মথুরায় এসেছেন। পুথিতে এর পরের পৃষ্ঠাগুলি পাওয়া যায়নি বলে এর পরের কাহিনি জানার উপায় নেই।

এই আখ্যান কাব্যে চরিত্র আছে তিনটি—কৃয়, রাধা এবং বড়াই। চরিত্রচিত্রণ ও কাহিনি বর্ণনায় পৌরাণিকতা থেকে মর্তজীবনের বৈশিষ্ট্যই প্রাধান্য পেয়েছে। তাতে চরিত্রগুলি যেন আরও জীবন্ত হয়ে ওঠার সুযােগ পেয়েছে। তিনটি চরিত্রের উক্তি-প্রত্যুক্তির মধ্য দিয়ে কাহিনির যেমন অগ্রগতি ঘটেছে, তেমনি বিকশিত হয়ে উঠেছে চরিত্রগুলিও।

আঙ্গিক সম্পর্কেও সচেতনতা লক্ষ করা যায় শ্রীকৃয়কীর্তন কাব্যে। পয়ার ও ত্রিপদী ছন্দের প্রয়ােগ ত্রুটিহীন হলেও কবির দক্ষতার পরিচয় দুর্লভ নয়। অলংকার শাস্ত্রের অনুসরণে উপমা, উৎপ্রেক্ষা, রূপক প্রভৃতি অলংকার প্রয়ােগের দৃষ্টান্তও পাওয়া যায়। সব মিলিয়ে শ্রীকৃয়কীর্তন কাব্য কেবল আদি-মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের অন্যতম নিদর্শন মাত্র নয়, সাহিত্যমূল্যের দিক থেকেও এটি যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ।