দশম শ্রেণীর বাংলা আফ্রিকা কবিতার প্রশ্নোত্তর পর্ব



● অতিসংক্ষিপ্ত উত্তরভিত্তিক প্রশ্নোত্তর 
(প্রশ্নমান - ১)
১) ‘উদ্ভ্রান্ত সেই আদিম যুগ’ আদিম যুগকে কবি উদভ্রান্ত বলেছেন কেন? 
উঃ আদিম যুগে স্রষ্টা অধৈর্যে, নিজের প্রতি অসন্তোষে নতুন সৃষ্টিকে বার বার ধ্বংস করছিলেন। তাই কবি পৃথিবী সৃষ্টির সূচনাকালের চঞল-বিল-ব্যাকুল রূপকে ‘উদ্ভ্রান্ত বলেছেন। 
২) ‘ছিনিয়ে নিয়ে গেল তােমাকে, আফ্রিকা আফ্রিকাকে ছিনিয়ে নিয়ে গিয়ে স্রষ্টা কী করছিলেন ?
উঃ আফ্রিকাকে ছিনিয়ে নিয়ে গিয়ে স্রষ্টা গহন অরণ্যে নিভৃত অবকাশে সংগ্রহ করছিলেন দুর্গমের রহস্য, ঘােষণা করছিলেন এই ধ্বংসলীলা আর তাণ্ডবের মহিমা। 
৩) ‘বিদ্রুপ করছিল ভীষণকে কীভাবে? 
উঃ আফ্রিকা সৃষ্টিকর্তাকে উপেক্ষা করে যেন ভীষণকে বিদ্রুপ করছিল বিরূপের ছদ্মবেশে আরও বীভৎস রূপে।
৪) অপরিচিত ছিল তােমার মানবরূপ’—আফ্রিকা কেন অপরিচিত ছিল? 
উঃ পৃথিবীর মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন বলেই সভ্যতার আলাে আফ্রিকায় পৌঁছায়নি। জঙ্গলাকীর্ণ ও অশিক্ষার অন্ধকারে আচ্ছন্ন আফ্রিকার মানুষজন সাগরপারের সভ্য মানুষদের কথা যেমন জানে না, ঠিক তেমনি বৃহত্তর মানবতাবােধে উদবুদ্ধ মানুষজনের কাছেও আফ্রিকা অবজ্ঞাত অপরিচিত। 
৫) ‘এল ওরা লােহার হাতকড়ি নিয়ে’কারা, কেন লােহার হাতকড়ি নিয়ে এল ? 
উঃ আফ্রিকাকে শাসন এবং শােষণ জালে আবদ্ধ করতে শ্বেতাঙ্গরা লােহার হাতকড়ি নিয়ে এল। 
৬) গর্বে যারা অন্ধ তাদের প্রকৃতি কীরূপ ছিল? 
উঃ ইউরােপে সভ্যতার গর্বে যারা অন্ধ তারা লােভী, বর্বর, নির্লজ্জ এবং অমানুষ। 
৭) ‘সভ্যের বর্বর লােভ’ কী ঘটিয়েছিল?
উঃ সভ্যের বর্বর লােভ তাদের নিজেদের নির্লজ্জ অমানুষতাকে নগ্ন করল।
৮) ‘চিরচিহ্ন দিয়ে গেল .. এখানে কোন্ চিহ্নের কথা বলা হয়েছে? 
উঃ সাম্রাজ্যবাদী শ্বেতাঙ্গরা তাদের কাটা-মারা জুতাের তলায় পিষে মেরেছিল আফ্রিকাবাসীকে। তারা আফ্রিকাবাসীকে দিয়ে গেল শুধু অপমান অবজ্ঞা মনুষ্যত্বহীনতার কলঙ্কচিহ্ন, যা ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায় সংযােজন করেছে। 
৯) মন্দিরে বাজছিল পূজার ঘণ্টা’ কোথায় কেন পূজার ঘণ্টা বাজছিল ? 
উঃ আফ্রিকায় যখন শ্বেতাঙ্গদের অত্যাচার চরমে ওঠে তখন সমুদ্রপারে অর্থাৎ সাম্রাজ্যবাদী সভ্য ইউরােপের পাড়ায় পাড়ায় মন্দিরে পুজোর ঘণ্টা বাজছিল। কেননা সেখানে ছিল না কোনাে অশান্তি, ভয়, লাঞ্ছনা, শােষণ, অবমাননা।
১০) আসন্ন সন্ধ্যার শেষ রশ্মিপাতে’—“আসন্ন সন্ধ্যা’ এবং শেষ রশ্মিপাত’ কথা দুটির অর্থ কী? 
উঃ সাম্রাজ্যবাদীদের বর্বর অত্যাচারে সভ্যতার ঘনীভূত সংকটকালকে কবি ‘আসন্ন সন্ধ্যা’ এবং সভ্যতা-সূর্যের বিলীয়মান শেষ আভাটুকুকে ‘শেষ রশ্মিপাত’ বলেছেন।
● সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যাধর্মী উত্তরভিত্তিক প্রশ্নোত্তর 
(প্রশ্নমান - ৩)
১) উদভ্রান্ত সেই আদিম যুগে’ স্রষ্টার কর্মকাণ্ড কী ছিল? 
উঃ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘আফ্রিকা’ কবিতায় দেখাতে চেয়েছেন আদিম যুগে নিজের প্রতি অসন্তোষে সৃষ্টিকর্তা ভাঙাগড়ার খেলায় মত্ত হয়েছেন। নিজের সৃষ্টির প্রতি তিনি সন্তুষ্ট হতে পারছিলেন না, তাই বার বার ধ্বংস করছিলেন নিজের সৃষ্টিকে। তাকে দেখে মনে হচ্ছিল যেন এক মূর্তিমান বিভীষিকা। ভূকম্পন, সমুদ্রের জলােচ্ছাস প্রাচ্য ভূভাগ থেকে আফ্রিকাকে করেছিল বিচ্ছিন্ন। ফলে আফ্রিকা হয়ে উঠল গহন অরণ্যের ছায়াঢাকা অন্ধকারাচ্ছন্ন এক মহাদেশ। 
২) ‘প্রকৃতির দৃষ্টি অতীত জাদু / মন্ত্র জাগাচ্ছিল, তােমার চেতনাতীত মনে’—কীভাবে
মন্ত্র জাগাচ্ছিল ? 
উঃ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘আফ্রিকা’ কবিতার এই অংশে আফ্রিকার শােচনীয় পরিণতির কথা চিন্তা করার সময় কবি ফিরে গিয়েছেন অতীত আফ্রিকার সৌন্দর্যের জগতে। অতীত আফ্রিকার শিল্প-সংস্কৃতির গুরুত্ব অপরিসীম। আফ্রিকার এই রহস্যময় প্রকৃতির ঐতিহ্যকেই কবি ‘দৃষ্টি-অতীত জাদু’ বলতে চেয়েছেন। অর্থাৎ অতীত আফ্রিকার রহস্যঘন নিবিড় অরণ্য কবির চেতনাতীত মনে মন্ত্র জাগাচ্ছিল।
৩) ‘সমুদ্রপারে সেই মুহূর্তে কী ঘটছিল ?  
উঃ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘ আফ্রিকা’ কবিতায় দেখিয়েছেন, যখন সাম্রাজ্যবাদীদের অমানুষিক অত্যাচারে আফ্রিকাবাসীর প্রাণ ওষ্ঠাগত তখন সভ্য ইউরােপীয় দেশগুলির মানুষ তাদের মন্দিরে ভিড় জমিয়েছে। পাড়ায় পাড়ায় মন্দিরে দয়াময় দেবতার পূজার ঘণ্টা বাজাচ্ছে, শিশুরা তাদের মায়ের কোলে খেলছে নিশ্চিন্ত মনে, কবির সংগীতেও বেজে উঠছিল সুন্দরের আরাধনা। অর্থাৎ পরপারে সভ্য দেশগুলিতে তখন ছিল শান্তির বাতাবরণ।
৪) ‘এসাে যুগান্তের কবি’ যুগান্তের কবিকে কখন, কেন আহ্বান করা হয়েছে? 
উঃ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘আফ্রিকা’ কবিতায় দেখানাে হয়েছে সাম্রাজ্যবাদী শক্তি আফ্রিকার বুকে নিষ্ঠুর নির্মম আঘাত হেনেছিল। তাদের বর্বর লােভ এবং পশুত্ব যখন অশুভ ধ্বনিতে ঘােষণা করছিল দিনের অন্তিমকাল তখনই যুগান্তের কবিকে আহ্বান করা হয়েছিল। যুগান্তের কবিকে আহ্বান করা হয়েছিল কারণ তিনি যেন মানহারা এই মানবীর পাশে এসে দাঁড়িয়ে ক্ষমার পূণ্যধারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে দেন এবং এই বর্বরতার অবসান ঘটান। 
৫) ‘আফ্রিকা’ কবিতার সারবত্তা কী ?
উঃ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘আফ্রিকা’ কবিতার সারবত্তা হল—সম্পদের লােভে, ক্ষমতার দম্ভে ইউরােপীয় সাম্রাজ্যবাদী শক্তি আফ্রিকা দখল করে সেখানে নিজেদের উপনিবেশ স্থাপন করেছে এবং নিপীড়ন করেছে আফ্রিকার জনজাতিকে। কিন্তু হিংসা কখনও সভ্যতার শেষ কথা হতে পারে না। তাই কবিতার শেষে কবি দেখিয়েছেন ক্ষমাই সভ্যতার শেষ পূণ্যবাণী।
● রচনাধর্মী উত্তরভিত্তিক প্রশ্নোত্তর 
(প্রশ্নমান - ১)
১) ‘আফ্রিকা’ কবিতায় ছায়াবৃতা কে? কবিতার বিষয়বস্তু নিজের ভাষায় লেখাে। 
উঃ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘আফ্রিকা’ কবিতায় ‘ছায়াবৃতা' হল আফ্রিকা মহাদেশ। ‘আফ্রিকা’ কবিতার শুরুতে কবি উভ্রান্ত যে আদিম যুগের উল্লেখ করেছেন বিশ্ব-সৃষ্টির সূচনাপর্ব। বিধাতা নিজের সৃষ্টির প্রতি সন্তুষ্ট হতে পারছিলেন না, ফলে বার বার তাঁর সৃষ্টিকে ধ্বংস করে আবার গড়ছিলেন। তাঁর অধৈর্যে এবং অস্থিরতায় বারবার ভূগঠনের পরিবর্তন হচ্ছিল। এইভাবে একসময় আফ্রিকাকে করে দিল বিচ্ছিন্ন এক ভূখণ্ড। সেখানে নিভৃত অবকাশে সৃষ্টিকর্তা আফ্রিকাকে করে তুলেছিল অন্ধকার, দুর্ভেদ্য, দুর্গম এক স্বপ্নের জগৎ। তার এই সৃষ্টি ভীষণকেও বিদ্রুপ করে, বিভীষিকাই যেন তার সৃষ্টির অনুপ্রেরণা।
সৃষ্টিকর্তার প্রচণ্ড উপেক্ষায় আফ্রিকা হয়ে উঠেছিল অরণ্যের অন্ধকারের ঘােমটায় ঢাকা। উপেক্ষিতা অনাদৃতা আফ্রিকাকে শােষণজালে আবদ্ধ করতে লােহার হাতকড়ি নিয়ে ধেয়ে এসেছিল স্বার্থান্বেষী, নির্লজ্জ অত্যাচারী শ্বেতাঙ্গের দল। নখ যাদের নেকড়ের চেয়েও তীক্ষ্ণ ও হিংস্র। তারা আগ্নেয়াস্ত্রের দুর্জয় ক্ষমতার গর্বে সূর্যহারা অরণ্যের চেয়েও অন্ধ। তাদের বর্বর, নির্লজ্জতার প্রকাশ ঘটল আফ্রিকাবাসীর উপর সীমাহীন শােষণ এবং নির্মম অত্যাচারে। নিরীহ আফ্রিকাবাসীর রক্তে ও চোখের জলে ধুলি হল পঙ্কিল। দস্যুর জুতাের কাটার নির্মম পেষণে সেই পঙ্কিল ধূলা কাদার পিণ্ডে পরিণত হল। এই অমানুষিক অত্যাচারের কাহিনি আফ্রিকার চিরকালের ইতিহাসকে কলঙ্কিত করল।
অমানুষিক অত্যাচারে আফ্রিকাবাসীর প্রাণ যখন ওষ্ঠাগত, তখন সমুদ্রপারে ইউরােপীয় মহাদেশের পাড়ায় পাড়ায় মন্দিরে দয়াময় দেবতার পূজার ঘণ্টা বাজছিল, শিশুরা খেলছিল মায়ের কোলে, কবির সংগীতেও বেজে উঠছিল সুন্দরের আরাধনা। সমুদ্রপারের কালাে মানুষদের দুর্দশার কোনাে প্রভাব এই শ্বেতাঙ্গদের উপর পড়েনি।
সাম্রাজ্যবাদী শক্তিদম্ভে যখন আফ্রিকার রুদ্ধশ্বাস অবস্থা, ঠিক তখনই যুদ্ধবাজের মনের গুহা থেকে বেরিয়ে এসেছে বর্বর পশুত্ব এবং তারাই অশুভ ধ্বনিতে ঘােষণা করছে দিনের অন্তিমকাল। কবি মানবসমাজের কাছে, মানবতার কাছে দায়বদ্ধ। তাই  আফ্রিকাবাসীর উপর সভ্যসমাজের বর্বর আচরণের জন্য তাদের উচিত আফ্রিকার কাছে ক্ষমা চাওয়া এবং বিশ্বস্রষ্টারও উচিত মানহারা এই মানবীর পাশে এসে দাঁড়ানাে।
২) ‘আফ্রিকা কবিতায় রবীন্দ্রনাথ আফ্রিকার জন্মের যে বর্ণনা দিয়েছেন তা আলােচনা করাে। 
অথবা, উদ্ভ্রান্ত সেই আদিম যুগে’—কীভাবে আফ্রিকার সৃষ্টি হল? 
উঃ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘আফ্রিকা’ কবিতায় বিশ্বমানবিকতার এক সুন্দর ছবি পাঠকের সামনে তুলে ধরেছেন। আদিম যুগের উভ্রান্ত রূপের ভৌগােলিক ব্যাখা হল—ভূবিজ্ঞানী আলফ্রেড ওয়েগনার নানা তথ্য থেকে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন—আদিমকালে পৃথিবী ছিল অখণ্ড একটি ভূখণ্ড। ভূমধ্যস্থ টেকটনিক প্লেটগুলাের নড়াচড়ার ফলে এই এক ভূখণ্ড বিচ্ছিন্ন হয়ে সৃষ্টি হয় বহু ভূখণ্ডের, যার থেকে সৃষ্টি হয় বিচ্ছিন্ন নতুন বহু দেশ-মহাদেশের। বিশ্বকবি দার্শনিকের চোখে দেখেছেন এই সৃষ্টি রহস্যকে। সৃষ্টিকর্তা নিজের সৃষ্টির প্রতি অসন্তোষে বারবার মাথা নাড়ছিলেন। তাঁর সৃষ্টির প্রতি অসন্তোষে, অতৃপ্তিতে নিজের ‘নতুন সৃষ্টিকে বারবার করছিলেন বিধ্বস্ত। এই ধ্বংস-সৃষ্টির লীলায় একসময় মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় আফ্রিকা এবং তার থেকেই সৃষ্টি হয় পৃথক এক মহাদেশের। এই পৃথক নতুন মহাদেশের প্রকৃতি যেন ‘দুর্গমের রহস্য’ আর ‘দুর্বোধ সংকেত’ দিয়ে গড়ে উঠেছে এবং ‘বনস্পতির নিবিড় পাহারায়’ ‘কালাে ঘােমটার নীচে’‘ছায়াবৃতা’ এই মহাদেশটি আফ্রিকা। এই নতুনভাবে গড়ে ওঠা আফ্রিকার অন্ধকার, দুর্ভেদ্য, দুর্গম প্রকৃতি যেন ভীষণকেও বিদ্রুপ করে, বিভীষিকাই যেন এই সৃষ্টির অনুপ্রেরণা। তবুও কবির চেতনাতীত মনে জাগছিল আশার বাণী। কবির আশা আফ্রিকা এই দুর্গমতাকে উপেক্ষা করে এবং যাবতীয় শঙ্কাকে দূর করে এক স্বপ্নের জগৎ গড়ে তুলতে পারবে।
Write Your HideComments
Cancel

Please Do Not Enter Any Span Link in The Comment Box