দশম শ্রেণীর বাংলা বহুরূপী গল্পের প্রশ্নোত্তর পর্ব
বহুরূপী গল্পের বড় প্রশ্ন উত্তর
বহুরূপী গল্পের প্রশ্ন উত্তর mcq
বহুরূপী গল্পের হরিদার চরিত্র
বহুরূপী গল্পের প্রশ্ন উত্তর saq
বহুরূপী গল্পের বিষয়বস্ত
● অতিসংক্ষিপ্ত উত্তরভিত্তিক প্রশ্নাবলি (প্রশ্নমান-১)
১)‘সে ভয়ানক দুর্লভ জিনিস’-জগদীশবাবু তা কীভাবে পেলেন?
উঃ জগদীশবাবুর বাড়িতে হিমালয়ের গুহাবাসী সন্ন্যাসীর পায়ের ধুলােকে ভয়ানক দুর্লভ জিনিস বলা হয়েছে। জগদীশবাবু একজোড়া সােনার বােল লাগানাে খড়ম সন্ন্যাসীর পায়ের সামনে ধরলেন এবং সন্ন্যাসী তা পরতে গেলে সেই সুযােগে তিনি পায়ের ধুলাে নিয়ে নিলেন।
২) আমাদের চারজনের .. – আমাদের চারজন কে কে?
উঃ আমাদের চারিজন হল হরিদা, অনাদি, ভবতােষ এবং আমি অর্থাৎ গল্পকথক নিজে।
৩) চায়ের আসরে হরিদার কাজ কী ?
উঃ হরিদা আমাদের কথায় সায় দিত আর নিজের রান্না নিয়ে ব্যস্ত থাকত। আমরা চা, চিনি দুধ অর্থাৎ চায়ের সব জোগাড় নিয়ে আসতাম হরিদা শুধু উনানের আঁচে জলটা ফুটিয়ে দিত।
৪) হরিদার অর্থনৈতিক অবস্থা স্বচ্ছল ছিল না কেন?
উঃ ঘড়ির কাঁটা ধরে কোনাে চাকরি বা কোনাে দোকানে কাজ করা হরিদার পছন্দ নয়, আবার কাউকে ঠকিয়ে বেশি পয়সা আদায় করাও তার স্বভাববিরুদ্ধ কাজ তাই তার অভাব কোনােদিন ঘুচত না।
৫) চকের বাসস্ট্যান্ডে হল্লা বেজে উঠেছিল কেন ?
উঃ মুখে লালা, লাল চোখ, ছেড়া কম্বল জড়ানাে, গলায় টিনের কৌটোর মালা পরা এক পাগল থান ইট নিয়ে বাসের লােকেদের তেড়ে গেলে তখনই ভয়ে সবাই হল্লা শুরু করে।
৬) আজ সন্ধ্যায় গল্পকথকেরা জগদীশবাবুর বাড়ি কোন অছিলায় যাবেন?
উঃ আজ সন্ধ্যায় গল্পকথকেরা অর্থাৎ অনাদি, ভবতােষ এবং কথক স্পাের্টের চাদা তােলার অছিলায় জগদীশবাবুর বাড়িতে যাবেন।
৭) জগদীশবাবু আশ্রয় দিতে চাইলে আগন্তুক কী বলেছিলেন ?
উঃ আগন্তুক বলেছিলেন তিনি বিরাগী, ধরিত্রীর বুকে খােলা আকাশ থাকতে তিনি কেন একজন বিষয়ীর দালান বাড়িতে থাকবেন।
৮) বিরাগীজি টাকা না নেওয়ার পিছনে কী যুক্তি দেখিয়েছেন?
উঃ বিরাগীজি টাকা না নেওয়ার পিছনে যুক্তি হিসেবে বলেছেন, তিনি যাঁর কাছে থাকেন তিনি জগদীশবাবুর চেয়ে কম নন, সুতরাং চাইবার দরকার হয় না।
৯) জগদীশবাবু দেখতে কেমন?
উঃ শান্ত, সৌম্য ও জ্ঞানী মানুষ জগদীশবাবু। তার চুল, দাড়ি পাকা অর্থাৎ সাদা।
১০) ধন জন যৌবন কিছুই নয়’—তবে এগুলােকে কী বলে বিরাগীজি মনে করেন?
উঃ ধন জন যৌবন’—এগুলিকে বিরাগীজি মনে করেন সুন্দর সুন্দর এক-একটি বঞ্চনা।
১১)‘অসম্ভব! হরিদার গলার স্বর এরকমেরই নয়।'—এ কথা বলার কারণ কী ?
উঃ ভবতােষ অনেকদিন থেকে অনেকভাবে হরিদাকে দেখে আসছে। কিন্তু আজ তার সঙ্গে—না কথার, না জ্ঞানের কোনাে মিলই সে খুঁজে পাচ্ছে না, তাই এই গলার স্বরকে হরিদার নয় বলেই মনে হয়েছে।
১২) জগদীশবাবু বিরাগীকে একশাে এক টাকা প্রণামী হিসেবে কেন দিতে চেয়েছিলেন?
উঃ জগদীশবাবু বিরাগীকে তার তীর্থ ভ্রমণের জন্য একশাে এক টাকা দিতে চেয়েছিলেন
১৩) যাবই তােকাকে, কেন হরিদা একথা বলেছেন?
উঃ বকশিশ প্রসঙ্গে অনাদির প্রশ্নের জবাবে হরিদা কথাটি বলেছে। জগদীশবাবুর কাছে৷ সব স্বীকার করে বকশিশটা আনতে যাবার কথাই হরিদা বলেছিলেন।
১৪) বহুরূপীর জীবন সম্পর্কে হরিদার মনােভাব কীরূপ?
উঃ অভাব আর আনন্দ মিশিয়েই বহুরূপীর জীবন। হরিদার মতে কাউকে ঠকিয়ে মােটা টাকা আদায় করে বসে খাওয়া বহুরূপীর জীবন নয়।
১৫) জগদীশবাবু তাে পাঁচশাে টাকা সাধলেন’—তবে কেন বিরাগী টাকাটা নিলেন না?
উঃ বিরাগীর ভূমিকায় অভিনয় করার সময় সত্যই হরিদা খাঁটি সন্ন্যাসী হয়ে গিয়েছিলেন, তাই টাকা-ফাকা স্পর্শ করতে পারেননি।
১৬) কী আশ্চর্য! চমকে ওঠে ভবতােষ।'—কেন চমকে ওঠে?
উঃ হরিদার বাড়িতে বিরাগীর পােশাক অর্থাৎ সাদা উত্তরীয়, ঝােলা আর গীতা দেখে ভবতােষ যখন বুঝতে পারল হরিদাই বিরাগী ছিল—তখনই সে চমকে ওঠে।
১৭) ‘পরম সুখ’ বলতে হরিদা কী বুঝিয়েছেন?
উঃ বিরাগীর ছদ্মবেশে হরিদা জগদীশবাবুকে বুঝিয়েছে সব পার্থিব সুখের বন্ধন থেকে নিজেকে মুক্ত রাখতে পারাই ‘পরম সুখ।
১৮) – বকশিশ? চেঁচিয়ে উঠে ভবতােষ।—চেঁচিয়ে কী বলেছিল ?
উঃ ভবতােষ রাগে-ক্ষোভে এবং হরিদার প্রতি ভালােবাসাতেই বকশিশের কথা উঠলে চেঁচিয়ে উঠে বলে বড়ােজোর আট আনা কিংবা দশ আনা হয়তাে জুটতে পারে।
১৯) ‘অদৃষ্ট কখনও হরিদার এই ভুল ক্ষমা করবে না।' – কোন ভুল ?
উঃ বিরাগী রূপী হরিদা তার নিজের ঢং নষ্ট হবে বলে জগদীশবাবুর কাছ থেকে কোনাে টাকা নেয়নি। অভাবের সংসারে এই টাকা না নেওয়াকে কথক ক্ষমার অযোগ্য ভুল বলে মনে করেছে।
● সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যাধর্মী উত্তরভিত্তিক প্রশ্নাবলি (প্রশ্নমান-৩)
১) ‘হরিদার কাছে আমরাই গল্প করে বললাম’—“আমরা কারা? বক্তারা হরিদাকে কী গল্প শুনিয়েছিল ?
উঃ সুবােধ ঘােষের ‘বহুরূপী’ গল্পে ‘আমরা বলতে গল্পকথক, ভবতােষ ও অনাদিকে বােঝানাে হয়েছে।
● শহরের ধনী মানী মানুষ জগদীশবাবুর বাড়িতে হিমালয় থেকেউঁদরের এক সন্ন্যাসী এসেছেন হাজার বছরের বেশি বয়সি এই সন্ন্যাসী সারাবছরে একটি মাত্র হরীতকী খেয়ে কাটান। তার প্রতি জগদীশবাবুর ভক্তি এবং খড়মে সােনার বােল বসানাের গল্পটা বক্তারা হরিদাকে শুনিয়েছিল।
২) ‘ছােট্টঘরটাই হরিদার জীবনের ঘর।'—ঘরটি কেমন?
উঃ শহরের সবথেকে সরু গলির ভিতর এই ছােট্ট ঘরটি যেখানে হরিদার জীবনে বেশিরভাগ সময়টা কেটেছে। যে ঘরে হরিদা থাকে সেখানে তার ফুটিয়ে দেওয়া জলে কথকেরা নিজেদের আনা চা, চিনি,দুধ মিশিয়ে চা খান আর সন্ধ্যাবেলার আড্ডাটা সারেন। কোনােভাবে রান্না আর ঘুমানাের জন্যই যেন ঘরটি তৈরি।
৩) এই ধরনের কাজ হরিদার জীবনের পছন্দই নয়।' –কোন্ কাজ? তা হরিদার পছন্দের নয় কেন?
অথবা, হরিদার প্রাণের মধ্যেই একটা বাধা আছে।'—বাধাটি কী? হরিদার প্রাণের বাধা কীরূপ?
উঃ সুবােধ ঘােষের ‘বহুরূপী’ গল্পে হরিদা ছকে বাঁধা জীবন পছন্দ করেন না, তাই অফিসে কাজ বা কোনাে দোকানে কাজ করা তার একদমই পছন্দ নয়।
● খেয়ালী মানুষ হরিদা। তিনি যেদিন যেখানে খুশি বহুরূপীর খেলা দেখিয়ে বেড়ান। প্রবল দারিদ্রেও তিনি তার রুজির পন্থার পরিবর্তন করেননি, মানুষকে ঠকিয়ে অধিক রােজগার করে বসে খাওয়ার মানুষও তিনি নন। এই মুক্ত মনের মানুষের তাই ঘড়ির কাঁটায় বাঁধা কোনাে চাকরি পছন্দের নয়।
৪) ‘তাতেই তার ভাতের হাঁড়ির দাবি মিটিয়ে দিতে চেষ্টা করেন।' – ‘তাতেই’ বলতে কী বােঝানাে হয়েছে? বক্তা কীভাবে তাঁর ভাতের হাঁড়ির দাবি মিটিয়ে দিতে চেষ্টা করেন?
উঃ সুবােধ ঘােষের ‘বহুরূপী’ গল্পে ‘তাতেই’ বলতে বহুরূপী সেজে হরিদার রােজগারের কথা বলা হয়েছে।
● হরিদা সকালে বা সন্ধ্যায় বহুরূপীর সাজে সজ্জিত হয়ে পথে বের হন। কেউ কেউ দু-এক আনা দেয় তাতেই হরিদার হাঁড়ির আবদারটা মেটে, না পেলে শুধু জল চাপিয়েই আবদার মেটান। তাঁর বহুরূপী খেলার মধ্যে উল্লেখযােগ্য হল বাসস্ট্যান্ডে পাগলের নিখুঁত অভিনয়, বাইজি সেজে বাজারে চেনা মানুষদের তাক লাগিয়ে এভাবে যে সাম্যন্য রােজগার হয় তাতেই হরিদা হাঁড়ির দাবি মেটান।
৫) সে কি সত্যই হরিদা? এরকম সংশয়ের কারণ কী?
উঃ চিরাচরিত জটাজুটধারী, গৈরিক কোনাে সন্ন্যাসী হরিদা সেদিন সাজেনি। তার খালি গায়ের উপর ছিল একটা সাদা উত্তরীয়, পরনে ছিল ছােটো বহরের সাদা থান। মাথায় সাদা চুল, ধুলি মাখা পা, হাতে একটি ঝােলা, তাতে ছিল একটি গীতা। হরিদার এরুপ সাজ দেখে ভবতােষদের সংশয় জেগেছিল।
৬) খুব চমৎকার পুলিশ সেজেছিল হরিদা। - বক্তা কে? পুলিশ সেজে হরিদা কী কেরামতি দেখিয়েছিল ?
উঃ সুবােধ ঘােষের বহুরূপী’ গল্পে এই উক্তিটির বক্তা স্কুলের একজন মাস্টারমশাই।
● একদিন হরিদা নকল পুলিশ সেজে দয়ালবাবুর লিচুবাগানে পঁড়িয়ে থাকা চার ছাত্রকে ধরে স্কুলে মাস্টারমশায়ের কাছে নিয়ে যান। মাস্টারমশাই ছেলেদের হয়ে হরিদার কাছে ক্ষমা চান এবং আট আনা ঘুষও দেন। পরে মাস্টারমশাই সব জানতে পারেন এবং নকল পুলিশ হরিদার উপর রাগ না করে তারিফ করেন।
৭) ‘আপনি কি ভগবানের চেয়েও বড়?'—কার প্রতি বস্তার এই উক্তি? এমন উক্তির কারণ কী?
উঃ সুবােধ ঘােষের বহুরুপী’ গল্পে উক্তিটি করেন শহরের ধনী মানী মানুষ জগদীশবাবুর প্রতি বিরাগীর সাজে থাকা হরিদা।
● হরিদা সাদা থান, সাদা উত্তরীয়, সাদা চুল, ধুলিমাখা পা, হাতে গীতা নিয়ে জগদীশবাবুর বাড়িতে প্রবেশ করে এক মােহাচ্ছন্ন পরিবেশের সৃষ্টি করেন। তাঁকে দেখেও না নেমে আসার জন্য কপট রাগ প্রকাশ করে হরিদা এই উক্তিটি করেছিলেন। বিশ্বাসযােগ্যতা বাড়াতেই এই কথার উপস্থাপনা।
● রচনাধর্মী উত্তরভিত্তিক প্রশ্নাবলি (প্রশ্নমান-৫)
১) ‘বহুরূপী’ গল্পের নামকরণের সার্থকতা বিচার করাে।
উঃ ‘বহুরূপী’ গল্পের কেন্দ্রীয় ভূমিকায় যে চরিত্রটি সর্বাধিক গুরুত্ব পেয়েছে তিনি হলেন হরিদা। তিনিই শিল্পী-বহুরূপী। তাঁর জীবনযাত্রা, তার চালচলন, তার কথাবার্তা, তার আদর্শ, তার ভাবনা-চিন্তা, মতামত—এসবই এ গল্পের মূল বিষয়। লেখক এ গল্পে একজন বহুরূপীর চরিত্রই অঙ্কন করতে চেয়েছেন তা পরিষ্কার বােঝা গেছে। একাধারে হরিদা ও তার ভেতরের বহুরূপীকে লেখক এই গল্পে ধরতে চেয়েছেন। সে চেষ্টা সার্থক হয়েছে। হরিদা নামের এক সাধারণ দরিদ্র মানুষের মধ্যে যে কী অসাধারণ একজন শিল্পী লুকিয়ে আছে তা টেনে বের করার চেষ্টা করেছেন লেখক। সেক্ষেত্রে যদি কেবল হরিদাকে প্রাধান্য দেওয়া হত তাহলে নামকরণ তাঁর নামেই হত। এখানে বহুরূপী নামকরণে অন্যতর ব্যঞ্জনা ফুটে উঠেছে। এ নামকরণকে একেবারে ব্যক্তিকেন্দ্রিক নামকরণ বলা যায় না। বহুরূপী’ হল একজন মানুষ যে নানারূপ ও বেশবাস ধারণ করে শুধুমাত্র অসাধারণ অভিনয়ের মাধ্যমে মানুষের মনােরঞ্জন করে। এটা একটা পেশা। গ্রামে-গঞ্জে দরিদ্র মানুষ, এমন সাজগােজ করা চরিত্রের রূপদান করে কিছু রােজগার করে। অনেকে এমন সাজগােজ করে মানুষকে মজা দিয়ে কিছু ভিক্ষে নেয়। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচিত শ্রীকান্ত প্রথম পর্বে আমরা শ্রীনাথ বহুরূপীকে বাঘ সেজে শ্রীকান্তের মামার বাড়িতে হুলস্থুল তৈরি করতে দেখেছি। এ গল্পের নামকরণটি সার্বিক বিচারে সার্থক এই সিদ্ধান্ত নেওয়া যেতে পারে।
২) ‘বহুরূপী’ গল্প অবলম্বনে হরিদার চরিত্র আলােচনা করাে।
উঃ গল্পকার সুবােধ ঘােষ তাঁর বহুরূপী’ গল্পে অপূর্ব মমত্বে হরিদা চরিত্রটি গড়ে তুলেছেন এক অতি সাধারণ মানুষ হরিদা, পেশায় বহুরূপী, শিল্পী, কিন্তু তাঁর জীবনদর্শন অন্যান্য সব মানুষের থেকে অনেকটাই আলাদা। শহরের এক এঁদো গলিতে একটি ছােট্ট ঘরে হরিদা থাকেন। তিনি অল্পবয়সিদের সঙ্গে আড্ডা দিয়ে অবসর সময়টা কাটিয়ে দেন।
● হরিদার চরিত্রের বিশেষ কয়েকটি দিক যা হরিদাকে আর পাঁচটা সাধারণ মানুষের থেকে পৃথক করেছে—প্রথমত, যে কাজ তিনি করেন অত্যন্ত মনােযােগের সঙ্গে করেন। বহুরূপীর সাজে অর্থাৎ রূপসি বাইজি, পাগল, কাপালিক, ফিরিঙ্গি প্রভৃতি যেদিন যা সেজে পথে বের হন সেদিন সেই অভিনয়টা অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে নিখুঁতভাবে করার চেষ্টা করেন। দ্বিতীয়ত, অল্পবয়সি ভিন্ন গােত্রীয়দের সঙ্গে আড্ডা দেওয়ার সময়েও তিনি তাঁর পেশা ও অর্থনৈতিক, সামাজিক অবস্থার কথা মাথায় রেখেই মাত্রা রেখে আড্ডা দেন। তৃতীয়ত, শিল্পী-সাহিত্যিককলাকুশলীদের জীবন যেরূপ হওয়া দরকার হরিদারও তা আছে। অর্থাৎ ছকে বাঁধা জীবন ও জীবিকা থেকে তিনি অনেক দূরে থাকেন। চতুর্থত, দারিদ্রকে তিনি বরণ করে নিয়েছেন ।
হরিদার যা ক্ষমতা মানুষকে চোখে ধুলাে দিয়ে বহু টাকা রােজগার করতে পারেন, কিন্তু প্রয়ােজনের বেশি রােজগারের তাগিদ তার নেই। আবার যেদিন রােজগার হয় না, সেদিন খালি হাঁড়িতে জল ফুটিয়ে রান্নার অভ্যাসটাকে বজায় রাখেন। পঞ্চমত, হরিদা সৎ এবং নির্লোভ মানুষ। জগদীশবাবুর বাড়িতে বিরাগীরূপী হরিদা একশাে এক টাকা প্রণামী ফিরিয়ে দিয়েছেন। ইচ্ছে করলে আরও অনেক টাকা সেখান থেকে রােজগার করতে পারতেন। ছােকরা বন্ধুরা বকশিশের কথা বললে তিনি জানান অন্য সময়ে বহুরূপীর বেশে গিয়ে সামান্য বকশিশ নিয়ে আসবেন। ষষ্ঠত, সম্মানীয়ের সম্মান তিনি দিতে জানেন। বহুরূপীর সাজে কোথাও গিয়ে তিনি কখনই মানীর মানহানি ঘটাননি। বন্ধুদের কাছে হিমালয় প্রত্যাগত সন্ন্যাসীর কথা শুনলে তাঁর প্রতি সম্মান জানিয়ে তাঁর পদধুলি নেওয়ার কথা বলেন।
● নিষ্ঠাবান, নির্লোভ, দরিদ্র মানুষ হরিদা সংসার সমাজ সবকিছুর থেকে যেন কেমন নির্লিপ্ত থাকতেন। অবশ্য তাঁর জীবনের এই ট্র্যাজিডির জন্য অনেকাংশেই সমাজ দায়ী। বহুরূপীর প্রতি অবহেলা এবং উপেক্ষাই বহুরূপী হরিদাকে সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করেছে।
৩) বহুরুপী গল্পে বহুরূপী হিসেবে হরিদার সাফল্য নিয়ে আলােচনা করাে।
উঃ বহুরূপী হিসেবে হরিদা এককথায় নিখুঁত, অনবদ্য, অসাধারণ। একটা উন্মাদ পাগলের সাজে তিনি যখন একটা ছেড়া কম্বল জড়িয়ে, গলায় টিনের কৌটোর একটা মালা ঝুলিয়ে, একটা থান ইট তুলে, টকটকে লাল চোখে, মুখে লালা ঝরিয়ে বাসের যাত্রীদের ভয় দেখাচ্ছেন তখন সকলে তটস্থ—কেবল ড্রাইভার কাশীনাথ তাকে চিনতে পারে। একবার দয়ালবাবুর বাগানে পুলিশ সেজে হরিদা মাস্টার মশাইকে বােকা বানিয়েছিলেন এবং শেষ পর্যন্ত ঘুষ দিয়ে ছাত্রদের ছাড়িয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। একবার সেজেছিলেন বাইজি—রূপসি বাইজির সে কী চোখমুখ ভােলানাে হাসি! চোখের ইঙ্গিত, চলার ছন্দ, ঘুঙুরের ধ্বনি, ফুলসাজি এগিয়ে টাকা-পয়সা রােজগারের ধূম। তারপর তাে দেখা গেল জগদীশবাবুর বাড়ি—আদুর গা, তার ওপর একটি ধবধবে সাদা উত্তরীয়, পরনে ছােটো বহরের সাদা একটা থান কাপড়। জগদীশবাবুর সেখানে উপস্থিত সকলে হরিদার স্বরূপ ধরতে পারেনি। এমন ছদ্মবেশ, এমন অভিনয়, এমন মনভােলানাে দেখনদারি—ভাবা যায় না।
৪) ‘এবার মারি তাে হাতি, লুঠি তাে ভাণ্ডার।'—কথাগুলির অর্থ কী ? প্রকৃতপক্ষে এই স্বপ্ন তাঁর কতদূর সফল হয়েছিল ?
উঃ জন্তুদের মধ্যে সর্ববৃহৎ ও শক্তিশালী হল হাতি। শিকার যদি করতেই হয় তাে হাতিই মারা দরকার। আর ছিচকে চোর না হয়ে রাজকোশ লুটতে পারলেই তাে বাকি জীবন পায়ের ওপর পা তুলে খাওয়া যাবে।
● জগদীশবাবুর বাড়িতে ছদ্মবেশে বিরাগী সেজে গিয়ে সেই বাজিই মারতে চেয়েছিলেন হরিদা। তার আদুর গা, ধবধবে সাদা উত্তরীয়, পরনে ছােটো বহরের সাদা থান। মাথায় শুকনাে সাদা চুল উড়ছে, ধুলাে মাখা পা, হাতে ঝােলা, ঝােলাতে একটি গীতা। তার উদাত্ত শান্ত, উজ্জ্বল চোখ, শীর্ণ শরীর। মানুষ ভগবানের চেয়ে বড়াে নয় এবং তার অহংকারী হওয়া উচিত নয়। হরিদার মতে বিনয় হল ভূষণ, পরম সুখ হল সকল কামনা-বাসনার উর্ধ্বে ওঠা, উদার মাঠ আর আকাশই তাে একজন মানুষের শেষ আশ্রয়—ঘর তাে মায়া, ধন জন যৌবন মায়া, অর্থ কামিনী, কাঞ্চন মায়া, বুকের ভেতর তীর্থ—সােনা তাে তুচ্ছ—ধুলােমাত্র। এইসব বলে হরিদা জগদীশবাবুর মন জয় করে পাঁচশাে টাকার উপঢৌকন বাগিয়ে নিতে গিয়েও পারলেন না—সত্যিই তাে এসবে তার কি হবে? অতএব ইচ্ছেটা ইচ্ছেই থেকে গেল। বহুরূপীর জীবনে সম্পদের ভূমিকা মূল্যহীন।
৫) জগদীশবাবু কে? জগদীশবাবুর চরিত্র বৈশিষ্ট্য আলােচনা করাে।
উঃ জগদীশবাবু হলেন স্থানীয় একজন ধনী, সৌম্য, সুন্দর, অভিজাত ভদ্রলােক। জগদীশবাবু সমাজের মান্যগণ্য ব্যক্তি। বাড়িতে অতিথি হওয়া সন্ন্যাসীকে তিনি সােনার বল লাগানাে খড়ম পড়ান। বিদায়-সময় আসন্ন হলে তিনি সন্ন্যাসীর ঝােলায় একশাে টাকার নােট ফেলে দেন। জগদীশবাবুর দেব-দ্বিজে খুব ভক্তি। তিনি অত্যন্ত বিনয়ী, মৃদুভাষী ভদ্রলােক। আপন আচরণের ত্রুটি সমালােচিত হলে মাথা নত করে মেনে নেন—লজ্জা পান। হরিদার ছদ্মবেশে বিভ্রান্ত ও বিমােহিত হয়ে তিনি তাঁর কাছে ক্ষমা চান। তাঁর সেবা করতে তাঁকে ঠান্ডা জল খাওয়ান। সিড়িতে বসে পড়ে ছদ্মবেশী হরিদার পা ধরতে আকুল হয়ে পড়েন। তিনি থলি ভরে বিরাগীজির জন্যে একশাে টাকা দেন। বিরাগীজি যেন তীর্থযাত্রার পথে ওই সামান্য পাথেয় সঙ্গে নেন। জগদীশবাবুর চিত্তে ভগবদ্ভক্তি প্রবল। দানধ্যান, শাস্ত্রপাঠ, সাধুসঙ্গ করতে চান। চারিত্রিক দিক থেকে অত্যন্ত ভদ্র-পরিশীলিত ব্যক্তি। সরল, সহজ মানুষটি প্রায়শই ভণ্ড মানুষের পাল্লায় পড়েন।