বাঙালির সমাজজীবনে চৈতন্যদেবের আবির্ভাবের গুরুত্ব আলােচনা করাে।

উত্তরঃ
চৈতন্য-আবির্ভাবের গুরুত্ব : বাঙালিসমাজে চৈতন্যদেবের আবির্ভাব এক ঐতিহাসিক ঘটনা। তার আবির্ভাবে বাংলার সমাজ ও সংস্কৃতিতে যুগান্তকারী পরিবর্তন দেখা দিয়েছিল।

১) চৈতন্যদেবের ধর্মান্দোলনের বিস্তারক্ষেত্র ছিল সমগ্র বাঙালিসমাজ। সমস্ত সংকীর্ণতার উর্ধ্বে উঠে যেভাবে তিনি অস্পৃশ্যতা বর্জনের আহ্বান জানিয়ে মানুষে-মানুষে সমভাবের কথা বলেছিলেন, সেকালের পক্ষে তা ছিল রীতিমতাে বৈপ্লবিক। তার এই মতবাদ জড়তাক্লিষ্ট, বর্ণবৈষম্যযুক্ত সমাজকে প্রবলভাবে নাড়া দিয়েছিল। “কলিযুগে ধর্ম হয় নামসংকীর্তন সার”—এই উদার ধর্মচেতনায় একদিকে চৈতন্য যেমন প্রাতিষ্ঠানিকতার দুর্গে আঘাত করেছিলেন, তেমনই তৈরি করেছিলেন জাতিধর্মনির্বিশেষে সম্প্রীতির পথ।
২) চৈতন্যদেবের প্রভাবে জনরুচির সামগ্রিক পরিবর্তন ঘটেছে, স্থূল গ্রাম্যতার বদলে পরিচ্ছন্ন মার্জিত সুরুচিবােধের উন্মেষ ঘটেছে জনমানসে। বাঙালি সংস্কৃতির বিভিন্ন ক্ষেত্রে স্নিগ্ধ-কোমল ভাবের বিস্তৃতি চৈতন্যপ্রভাবের অন্যতম অবদান।
৩) নৈতিক আদর্শের মান প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে চৈতন্যদেবের মনােভাব অত্যন্ত দৃঢ় ছিল। সমকালীন নীতিভ্রষ্ট সমাজে তার প্রভাব নৈতিক মানােন্নয়নের সহায়ক হয়েছে।
৪) ভিন্ন ধর্ম বা ভিন্ন ধর্মসম্প্রদায় সম্পর্কে সহিষ্ণুতার শিক্ষা দিয়েছেন চৈতন্যদেব। তিনি শিখিয়েছেন বিনয়ী হতে ।
৫) পরােপকারের মধ্য দিয়ে জীবনের পরম সার্থকতা লাভ হয়—এই উপদেশ তিনি দিতেন। জন্ম সার্থক করি করাে পর-উপকার’—সমকালের সমাজ তার ধর্মসাধনা থেকে এ শিক্ষা পেয়েছিল।
৬) চৈতন্যের ভারতভ্রমণ সুনিশ্চিত করেছিল ভাব বিনিময়ের পথ। এক সুতােয় গেঁথেছিল তুকারামরামানন্দ-অদ্বৈতাচার্য, উত্তর-দক্ষিণ-পূর্ব-পশ্চিমকে। এভাবেই সেই মধ্যযুগে জাতীয় সংহতির পথ প্রশস্ত করেছিলেন চৈতন্যদেব।

সব মিলিয়ে বলা যায়, ধর্মকে কেন্দ্র করে হলেও তিনি সেকালের বাঙালি জীবনে নবজাগরণ ঘটিয়েছিলেন—যার ফল হয়েছিল সুদূরপ্রসারী।
Write Your HideComments
Cancel

Please Do Not Enter Any Span Link in The Comment Box