বাংলা সাহিত্যে চৈতন্যদেবের প্রভাব আলােচনা করাে।

উত্তরঃ 
বাংলা সাহিত্যে চৈতন্য-প্রভাব: চৈতন্যদেব নিজে কোনাে গ্রন্থ রচনা না করলেও বাংলা সাহিত্যে তার প্রত্যক্ষ ও পরােক্ষ প্রভাব বর্তমান।

চৈতন্যপূর্ব যুগেও বৈষ্ণব পদাবলিতে কৃষ্ণের ঐশ্বর্যভাব আরাধ্য ছিল, কিন্তু রাগানুগা ভক্তিবাদের প্রভাবে চৈতন্যপরবর্তী যুগে কৃষ্ণের মাধুর্যভাব উপাস্য হল। ভক্ত-ভগবানের সম্পর্কের বদলে রাধা-কৃষ্ণ হলেন পরম প্রেমিক পরম প্রেমিকা। বৈষ্ণব পদাবলিতে জোয়ার আসে গােবিন্দদাস, জ্ঞানদাস, বলরাম দাস, যদুনন্দন, নরহরি চক্রবর্তী প্রমুখ বৈষ্ণব কবির রচনায়। চৈতন্যদেবের প্রভাবে বৈষ্ণব পদাবলিতে ‘গৌরচন্দ্রিকা' নামে একটি নতুন ধারার সংযােজন ঘটে। গৌরচন্দ্রিকা ছাড়া সাধারণ গৌরাঙ্গ-বিষয়ক পদও প্রচুর রচনা করেছেন বৈষ্ণব কবিরা। মহাপ্রভুর সমগ্র জীবনকে অবলম্বন করে বাংলা সাহিত্যে প্রথম জীবনীসাহিত্যের সূচনা ঘটে। বৃন্দাবন দাসের ‘চৈতন্যভাগবত’, জয়ানন্দ ও লােচনদাসের ‘চৈতন্যমঙ্গল’, কৃষ্ণদাস কবিরাজের ‘চৈতন্যচরিতামৃত' প্রভৃতি গ্রন্থ বাংলা সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ।

চৈতন্যদেবের আবির্ভাবে বৈষ্ণব সাহিত্যের শ্রীবৃদ্ধি ঘটেছে সবচেয়ে বেশি। তবে তাকে কেন্দ্র করে যে ধর্মান্দোলনের সূচনা ঘটেছিল তার প্রভাব পড়েছে চৈতন্যপরবর্তীকালের সমগ্র বাংলা সাহিত্যে। অনুবাদ সাহিত্য, মঙ্গলকাব্য এবং লােকসাহিত্যের ক্ষেত্রেও এই প্রভাব বিশেষভাবে লক্ষ করা যায়। কাশীরাম দাসের বাংলা মহাভারতের মর্মে মর্মে এ কারণেই বৈষ্ণবীয় রুচি ও কোমলতার স্পর্শ অনুভূত হয়। চৈতন্যোত্তর কালের মঙ্গলকাব্যের দেবদেবীর প্রকৃতিতে তাই মাধুর্য সঞ্চারিত হয়েছে; মঙ্গলকাব্যের বন্দনা-অংশে স্থান পেয়েছে ‘চৈতন্যবন্দনা'। অষ্টাদশ-উনবিংশ শতাব্দীর শাক্তপদাবলি ও বাউল সংগীতের মধ্যেও যে ভক্তিরসের ধারা প্রবাহিত, তার উৎসেও চৈতন্য-প্রভাবের প্রতিফলন আছে। আসলে চৈতন্য মহাপ্রভুর অসাধারণ ব্যক্তিত্ব বিভিন্ন দিক থেকে বাংলা সাহিত্যসৃষ্টির ধারাকে প্রভাবিত ও পরিপুষ্ট করেছে। তার প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়েছে বৈষ্ণব সাহিত্যে আর পরােক্ষ প্রভাবে সমৃদ্ধ হয়ে উঠেছে বাংলা সাহিত্যের অন্যান্য শাখা।
Write Your HideComments
Cancel

Please Do Not Enter Any Span Link in The Comment Box